মধ্যরাতে সিবিআই ডিরেক্টরের পদে নিয়োগের লগ্ন থেকেই বিতর্ক যেন পিছু ছাড়ছে না নাগেশ্বর রাওয়ের। কেন্দ্রীয় ক্যাবিনেটের নির্দেশানুযায়ী, সিবিআই-এর তত্কালীন ডিরেক্টর অলোক ভার্মা এবং স্পেশ্যাল ডিরেক্টর রাকেশ আস্থানাকে সরিয়ে ২৩ অক্টোবর মধ্যরাতে সংস্থার অন্তর্বর্তীকালীন প্রধান পদে বসানো হয় ওড়িশা ক্যাডারের ১৯৮৬ ব্যাচের আইপিএস অফিসার এম নাগেশ্বর রাওকে। এরপর দিন অর্থাৎ বুধবার সকালেই সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়ে এই কেন্দ্রীয় নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ জানান অলোক ভার্মা। সেই আবেদনের শুনানিতে শুক্রবার দেশের শীর্ষ আদালত জানিয়ে দেয়, নাগেশ্বর রাও সিবিআই-এর কোনও নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারবেন না, কেবল সংস্থাটির দৈনন্দিন কাজকর্ম পরিচালনা করবেন এবং নিয়োগের মুহূর্ত থেকে নাগেশ্বর রাও যে সব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা লিখিতভাবে মুখ বন্ধ খামে ১২ নভেম্বর আদালতে জমা দিতে হবে।
কংগ্রেস-সহ একাধিক বিরোধী দল দীর্ঘদিন ধরেই দাবি করে আসছে, সিবিআই-এর মতো সংস্থাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছে মোদী সরকার। একদা 'কংগ্রেস ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন' বা 'খাঁচায় বন্দি তোতাপাখি' বলে যে সিবিআই-কে সমালোচনা করা হত, সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে তাকেই 'বিজেপি ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন' হিসাবে উল্লেখ করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এদিকে, অলোক ভার্মার অপসারণের সিদ্ধান্তে লক্ষ্যনীয়ভাবে সরব হয়েছেন স্বয়ং রাহুল গান্ধী। তাঁর দাবি, অলোক ভার্মা রাফাল 'দুর্নীতি'র তদন্ত শুরু করেছিলেন বলেই, তাঁকে সরিয়ে দিয়েছেন মোদী। এমন আবহে অলোক ভার্মার আবেদনের শুনানিতে শুক্রবার সুপ্রিম কোর্ট নাগেশ্বর রাওকে ঠুঁটো করে দেওয়ায়, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক মহলে রীতিমতো আলোচনা শুরু হয়েছে। কিন্তু, ২৩ অক্টোবর মধ্যরাতে দায়িত্ব পেয়ে এটুকু সময়ের মধ্যে কী কী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এম নাগেশ্বর রাও? আসুন, জেনে নেওয়া যাক-
* ক্ষমতা পেয়েই দিল্লি পুলিশের নিরাপত্তা নিয়ে রাত ১টা ৩০মিনিটে সিবিআই-এর প্রধান কার্য্যালয়ের এগারো তলা 'সিল' করে দেন রাও। এই এগারো তলাতেই বসতেন দুই বিবাদমান সিবিআই কর্তা- অলোক ভার্মা এবং রাকেশ আস্থানা। তিনি নিজে ওই ভবনেরই দশ তলায় বসবেন বলে ঠিক করেন।
আরও পড়ুন- সিবিআইয়ে রদবদল কতটা প্রভাব ফেলবে আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে?
* অন্তর্বর্তীকালীন সিবিআই ডিরেক্টরের পদে নিযুক্ত হওয়ার পর থেকে এই মুহূর্ত পর্যন্ত সিবিআই-এর মোট ১৪ অফিসারকে বদলি করেছেন নাগেশ্বর রাও। বদলি হওয়া অফিসারদের অধিকাংশই রাকেশ আস্থানার বিরুদ্ধে ঘুষের অভিযোগে তদন্তকারী অফিসার। এই অফিসাররা অলোক ভার্মার খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন।
*যে সব অফিসারদের দায়িত্ব বদলানো হয়েছে, তারমধ্যে সবচেয়ে তাত্পর্যপূর্ণ জয়েন্ট ডিরেক্টর (পলিসি)-র পদ। এই পদটিকে কার্যত গুরুত্বহীন করে দেওয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, এই পদে কর্মরত এ.কে. শর্মাও ভার্মা ঘনিষ্ঠ ছিলেন। প্রসঙ্গত, অতীতে দু'বার দেখা গিয়েছে জয়েন্ট ডিরেক্টর (পলিসি) পদে থাকা অফিসাররাই সিবিআই ডিরেক্টর হয়েছেন। বেশ কিছু অতিগুরুত্বপূর্ণ তদন্ত আস্থানার হাত থেকে নিয়ে তা এ.কে. শর্মাকে দিয়েছিলেন অলোক ভার্মা।
আরও পড়ুন- সিবিআই-এ ক্ষমতা হস্তান্তর, কোন সাতটি ফাইল পড়ে রইল?
*অনীশ প্রসাদের বদলিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছে সংশ্লিষ্ট মহল। সিবিআই-তে বরাবরই সার্ভিলেন্স ইউনিটের (SU) ডিআইজি পদের বিশেষ ভূমিকা। SU ইউনিট আদপে সিবিআই-এর গোয়েন্দা বিভাগ। অনীশ প্রসাদ ছিলেন এই ডিআইজি, এসইউ-১ পদে। জুলাই মাসে ভার্মা ও আস্থানার মধ্যে চলতে থাকা দড়ি টানাটানির কেন্দ্রে ছিলেন অনীশ প্রসাদ। তাঁর মেয়ের বিয়ের তদন্তের বিষয়ে সেন্ট্রাল ভিজিলেন্স কমিশনকে লেখা চিঠিতে আকেশ আস্থানা দাবি করেছিলেন, সিবিআই পরিবারের অন্দরে আঁড়ি পাতছে। এর ফলে আস্থানা পরিবারের ব্যক্তি জীবন ও গোপনীয়তা ভঙ্গ হচ্ছে।
*রাকেশ আস্থানার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের তদন্তকারী অফিসার ডিএসপি এ.কে. বসসি-কে পোর্ট ব্লেয়ারে পদলি করে দেওয়া হয়েছে।
*অলোক ভার্মার ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত অতিরিক্ত এসপি, AC III এস. এস. গুর্নকে জব্বলপুরে বদলি করা হয়েছে।
*ডিআইজি, AC III এবং ব্যাঙ্কিং অ্যান্ড সিকিউরিটিজ ফ্রড সেলের ডিআইজি এম.কে. সিনহাকে দিল্লির প্রধান কার্য্যালয় থেকে নাগপুর অফিসে বদলি করে দেওয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, এ.কে. শর্মার অধীনস্থ এম.কে. সিনহা পিএনবি দুর্নীতির মতো হাই প্রোফাইল মামলার তদন্ত করছিলেন।
পক্ষান্তরে রাকেশ আস্থানার ঘনিষ্ঠ অফিসারদের অপেক্ষাকৃত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
*আস্থানার বিশেষ তদন্তকারী দলের (সিট) অতিগুরুত্বপূর্ণ অফিসার তথা জয়েন্ট ডিরেক্টর এ সাই মনোহরকে চন্ডিগড় জোনের জয়েন্ট ডিরেক্টর পদে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তবে, বদলির নির্দেশে এও বলা হয়েছে যে, 'জনস্বার্থে' তিনি সিট ও টেকনিক্যাল ফরেনসিক অ্যান্ড কো-অর্ডিনেশনের অতিরিক্ত দায়িত্বও সামলাবেন এবং দিল্লির প্রধান কার্য্যালয়েই বসবেন।
*ডিআইজি (স্পেশ্যাল ক্রাইম) পদে থাকা যশবীর সিং-কে বিএসএফসি-র অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এই বিএসএফসি-র দায়িত্ব আগে সামলাতেন এ.কে. শর্মা।
এম নাগেশ্বর রাও-এর নেওয়া এইসব সিদ্ধান্তগুলি সেই সময় সিবিআই-এর অন্দরে গৃহীত হলেও এখন নিঃসন্দেহে শীর্ষ আদালতের বিবেচনাধীন। তার উপর এই ধরনের নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাও খুইয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন ডিরেক্টর। তাই মধ্যরাতে দায়িত্ব পাওয়া নাগেশ্বর কি আদৌ বিতর্কের অন্ধকার থেকে মুক্তি পাবেন, না কি বিতর্কের নাগপাশে আরও জড়িয়ে পড়বেন, উত্তর দেবে আগামী দিন।