বিশিষ্ট আইনজীবী তথা প্রাক্তন কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী রাম জেঠমালানি রবিবার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৫ বছর। এদিন নয়া দিল্লিতে নিজের বাস ভবনে সকাল ৭.৪৫ মিনিট নাগাদ প্রাণ ত্যাগ করেন তিনি।
দেশের ইতিহাসে অতীব গুরুত্বপূর্ণ কিছু রাজনৈতিক মামলা লড়েছেন রাম জেঠমালানি। এর মধ্যে রয়েছে প্রয়াত রাজীব গান্ধীর পক্ষে মামলা, শেয়ার মার্কেট কেলেঙ্কারিতে অভিযু্ক্ত হর্ষদ মেহতার হয়ে মামলা, হাওয়ালা কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত লালকৃষ্ণ আদবানির হয়ে মামলা, সোহরাবুদ্দিন ভুয়ো সংঘর্ষ মামলায় অমিত শাহের পক্ষে মামলা।
রইল কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মামলার খতিয়ান
নানাবতী বনাম মহারাষ্ট্র সরকার
১৯৫৯ সালে নৌবাহিনীর কম্যান্ডার কাওয়াস মানেকশ নানাবতীর বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে তিনি নিজের স্ত্রীর প্রেমিক প্রেম আহুজাকে হত্যা করেছেন। এ মামলায় সরকারের হয়ে সওয়াল করেন জেঠমালানি। হাইকোর্ট তাঁর সওয়ালের সঙ্গে একমত হয় যে এ হত্যাকাণ্ড ছিল পূর্বপরিকল্পিত এবং নানাবতীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দেয়। ১৯৬১ সালের ২৪ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টও সে রায় বহাল রাখে।
সোহরাবুদ্দিন ভুয়ো সংঘর্ষ মামলায় অমিত শাহের পক্ষে
২০০৫ সালে সোহরাবুদ্দিন ভুয়ো সংঘর্ষ মামলায় জেঠমালানি বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের হয়ে মামলা লড়েন। অমিত শাহের বক্তব্য ছিল কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার সিবিআই-কে কাজে লাগিয়ে গুজরাটের প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ফাঁসাচ্ছে। জেঠমালানি বলেন, কেন্দ্র সিবিআইয়ের সঙ্গে মিলে ষড়যন্ত্র করে মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর সরকারকে টার্গেট করছে, এঁদের মধ্যে সর্বপ্রথম শিকার হলেন অমিত শাহ।
অভিযোগ ছিল ২০০৫ সালের নভেম্বর মাসে ভুয়ো সংঘর্ষে সোহরাবুদ্দিন এবং কৌসর বাঈকে হত্যা করে গুজরাট পুলিশ। একই ভাবে ২০০৬ সালের ২৭ ডিসেম্বর তুলসীরাম প্রজাপতিকে খুন করা হয় বলেও অভিযোগ। সে সময়ে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন নরেন্দ্র মোদী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন অমিত শাহ।
হাওয়ালা কেলেঙ্কারিতে এল কে আদবানির পক্ষে
৯-এর দশকের শুরুতে প্রাক্তন উপপ্রধানমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আদাবানির বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া হাওয়ালা কেলেঙ্কারির মামলায় তাঁর আইনজীবী ছিলেন জেঠমালানি। ১৮ মিলিয়ন ডলারের এই কেলেঙ্কারিতে আদবানি ছাড়াও অভিযুক্ত ছিলেন শরদ যাদব, মদনলাল খুরানার মত রাজনৈতিক নেতারা। ২০১৫ সালে জেঠমালানি বলেন, হাওয়ালা মামলায় তিনি লড়েছিলেন বলে জিতেছিলেন আদবানি।
২জি কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত কানিমোজির পক্ষে
যে কুখ্যাত ২জি কেলেংকারি মামলা কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ ২-কে নাড়িয়ে দিয়েছিল, সে মামলায় ডিএমকে সাংসদ কানিমোজির হয়ে লড়েছিলেন রাম জেঠমালানি। গত বছরই এ মামলায় খালাস পান কানিমোজি, প্রাক্তন টেলিকম মন্ত্রী এ রাজা সহ অন্যান্যরা। বিশেষ আদালত তাদের রায়ে বলে, অভিযোগকারীরা অভিযোগ প্রমাণ করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। সিবিআই অভিযোগ করে ২জি-তে মোট ক্ষতির পরিমাণ ৩০,৯৮৪ কোটি টাকা।
যৌন হেনস্থার মামলায় আসারাম বাপুর পক্ষে
এক কিশোরীকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে ২০১৩ সালে গ্রেফতার করা হয় আসারাম বাপুকে। সে ধর্মগুরুর হয়ে আইনি লড়াই লড়েছিলেন রাম জেঠমালানি। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জেঠমালানি বলেন, তথ্যের দিক থেকে দেখলে এ মামলা নিয়ে অনেক তর্ক বিতর্ক রয়েছে। এটা মোটেই সাধাসিধে মামলা নয়, এবং যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে যে এ মামলা দাঁড়াবেই না। তিনি কেন আসারাম বাপুর হয়ে আইনি লড়াই লড়ছেন, এ প্রশ্নের জবাবে জেঠমালানি বলেন, আমার প্র্যাকটিসের ধরন অন্য আইনজীবীদের থেকে ভিন্ন। আমি আইনজীবী হিসেবে প্রচুর টাকা রোজগার করি, কিন্তু তা করি ১০ শতাংশ ক্লায়েন্টের কাছ থেকে। বাপু সে ১০ শতাংশের মধ্যে। ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে আসারাম বাপুকে ধর্ষণে অপরাধী সাব্যস্ত করা হয় এবং যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। একই সঙ্গে ৫ লক্ষ টাকা জরিমানারও নির্দেশ দেওয়া হয়, যে অর্থ লাঞ্ছিতাকে দেওয়া হবে বলে জানিয়ে দেয় আদালত। আসারামের দুই সহযোগীকে ২০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীন মামলায় জয়ললিতার পক্ষে
তামিলনাড়ুর প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে, ১৯৯১-৯৬ সময়কালে মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন, ওই সময়ে তিনি ৬৬ কোটি টাকার সম্পত্তি তৈরি করেছেন। ২০১৪ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর এক রায়ে বিশেষ আদালত জয়ললিতা, শশীকলা নটরাজন সহ সকলকে দোষী সাব্যস্ত করে এবং তাঁদের চার বছরের জন্য কারাদণ্ডের নির্দেশ দেয়। জয়ললিতার হয়ে আদালতে জেঠমালানি আবেদন করেন তাঁর শাস্তি ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৮৯ ধারা মোতাবেক বিলম্বিত করা হোক। জেঠমালানি এ ব্যাপারে লালু প্রসাদ যাদবের পশুখাদ্য কেলেঙ্কারির মামলার উদাহরণ দেন, যে মামলাতেও তিনি লালুপ্রসাদের হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন।
জেসিকা লাল হত্যা মামলায় মনু শর্মার পক্ষে
১৯৯৯ সালের কুখ্যাত জেসিকা লাল হত্যা মামলায় জেঠমালানি মনু শর্মার পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। হরিয়ানার কংগ্রেস নেতা বিনোদ শর্মার ছেলে মনু শর্মা মডেল জেসিকা মামলায় অভিযুক্ত হয়। দক্ষিণ দিল্লির এক রেস্তোরাঁয় পানীয় না দেওয়ায় জেসিকা লালকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ২০০৬ সালে নিম্ন আদালত মনু শর্মাকে খালাস করে দেওয়ার পর ব্যাপক জনরোষ সৃষ্টি হয়। এ মামলায় মনু শর্মার কৌঁশুলি হওয়ার জন্য রাম জেঠমালানিকে ব্যাপক সমালোচিত হতে হয়। তাঁর মেয়ে রানি জেঠমালানিও বাবার সমালোচনায় সরব হন। তবে তাতে থেমে যাননি রাম জেঠমালানি। হাইকোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্টে মনু শর্মার হয়ে লড়ে গিয়েছিলেন তিনি।
Read the Full Story in English