জম্মু-কাশ্মীরে আত্মঘাতী হামলায় ৪০ জন সিআরপিএফ জওয়ানের মৃত্যুর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পাকিস্তানের জৈশ-এ-মহম্মদ এ ঘটনায় তাদের দায় স্বীকার করে নিয়েছে। গত দু দশক জুড়ে এই সংগঠনটি ভারত জুড়ে বেশ কিছু হামলা চালানো সত্ত্বেও তাদের নেতা মৌলানা মাসুদ আজহারের উপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয় নি।
এই অপারগতার পিছনে রয়েছে চিন। রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে এ ব্যাপারে টেকনিক্যাল কারণ দেখিয়ে বেজিং আজহার মাসুদকে আন্তর্জাতিক অপরাধী ঘোষণা করতে দেয় নি। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পাঠানকোট হামলার পরে ভারত রাষ্ট্রসংঘের মানবাধিকার পরিষদে আজহারকে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী ঘোষণার প্রস্তাব দেয়। তখন থেকে চারবার চিন এ ব্যাপারে তাদের আপত্তি জানিয়েছে। তাদের সাম্প্রতিকতম আপত্তি আসে ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে।
আজহারকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার ব্যাপারে চিনের এত আপত্তি কেন? তার মূল কারণ হল দক্ষিণ এশিয়ায় তাদের সর্বসময়ের সঙ্গীকে রক্ষা করা। এ প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে, চিন-পাক ইকোনমিক করিডোর (CPEC)-এর কথা। এর সঙ্গে রয়েছে এশিয়ায় তাদের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমি শক্তিগুলির কাছে নিজেদের অবস্থান প্রমাণ করতে না দেওয়ার চেষ্টাও।
আরও পড়ুন, মাসুদ আজহারকে সন্ত্রাসবাদী ঘোষণা: পথের কাঁটা চিন
চিনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের একটি প্রকল্প আছে, তা হল বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI), যার মাধ্যমে সড়ক, রেল এবং সমুদ্রপথে পরিকাঠামো নির্মাণের মাধ্যমে এশিয়া, ইউরোপ এবং আফ্রিকাকে সংযুক্ত করা হবে। চিন-পাক ইকোনমিক করিডোর (CPEC) পাকিস্তানের মধ্যে দিয়ে গেছে। চিনের জিনজিয়াং প্রদেশের কাশগরের সঙ্গে এ পথ গিয়ে মিলেছে পাকিস্তানের গদর গভীর সমুদ্র বন্দরে। গদর পাক-ইরান সীমান্তে আরব সাগরে অবস্থিত। সিপেক (CPEC)-এর ৪৫টি প্রকল্পে প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলার লগ্নি করেছে চিনা সংস্থাগুলি। এই বহুল পরিমাণ লগ্নিকৃত অর্থ, মানবশক্তি এবং সময়ের সুরক্ষায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ চিন। গদর বন্দরের মাধ্যমে যোগাযোগ স্থাপিত হয়ে গেলে পশ্চিমের সঙ্গে চিনের যোগাযোগের বর্তমান যে পথ, তা অনেকটাই কমে আসবে শুধু নয়, তৈল পরিবাহী জাহাজপথের সঙ্গে তাদের নিবিড় যোগাযোগও তৈরি হবে।
পাকিস্তানের সঙ্গে ভাল সম্পর্ক, এবং জৈশের মত আইএসআই প্রক্সিদের যদি চিন আন্তর্জাতিক সুরক্ষাকবচ দেয়, তাহলে সিপেক পরিকাঠামোর উপর সন্ত্রাসবাদী হামলা না হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চয়তা পাওয়া যাবে। সিপেকে হাজার হাজার চিনা কর্মরত রয়েছেন। এ প্রকল্পে হানাদারির লক্ষ্য রয়েছে বালোচ বিভেদকামী এবং পাকিস্তানি তালিবানদের। পূর্ব জিনজিয়াং প্রদেশে সংখ্যালঘু উইঘুর মুসলিমদের প্রতি চিন সরকারের যে আচরণ, তার বিরুদ্ধে লড়াই চালাচ্ছে এরা। পাকিস্তান সিপেকের নিরাপত্তার ব্যাপারে বেজিংকে নিশ্চয়তা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। ২০১৫ সালে পাকিস্তান কেবলমাত্র সিপেকের নিরাপত্তার জন্য ২০ হাজার কর্মীর বাহিনী তৈরি করে। কর্মী নেওয়া হয় সেনা ও আধা সেনা থেকে, শীর্ষে রাখা হয় এক মেজর জেনারেল পদের অফিসারকে।
কিন্তু নিরাপত্তা দেওয়া হয়ে থাকলে, চিন আজহারের ব্যাপারে নীরব কেন?
আফগান তালিবানদের পূর্বসূরীদের সঙ্গে ১৯৭০ থেকেই বোঝাপড়া ছিল চিনের, বলছেন জেএনইউ-য়ের সেন্টার ফর ইস্ট এশিয়ান স্টাডিজের অধ্যাপক শ্রীকান্ত কোন্ডাপল্লী। সোভিয়েটদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহরত মুজাহিদিনদের ট্রেনিং দিয়েছে চিনারা, এবং উইঘুরদের যতক্ষণ তারা সমর্থন না করছে, ততদিন তাদের ক্ষতি করা হবে না, এই মর্মে তালিবানদের সঙ্গে চুক্তিও করেছে তারা। এই তালিবানদের মধ্যে মুল্লা উমর সহ অনেকেই রয়েছে, যারা আগে মুজাহিদিন কম্যান্ডার ছিল। "উইঘুরদের ট্রেনিং দিও না, আমরা নাক গলাব না" - এই চুক্তি এখনও বহাল রয়েছে বলে জানিয়েছেন অধ্যাপক কোন্ডাপল্লী।
বছর দশেক আগে জিনজিয়াংয়ে এক বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় জড়িত উইঘুরের এক শীর্ষ নেতার হদিশ মেলে পাকিস্তানে। তাকে বেজিংয়ের হাতে তুলে দেওয়া হয়। অধ্যাপক কোন্ডাপল্লী বলছেন, "এর সঙ্গে সন্ত্রাসবাদীদের ভারতের হাতে তুলে দেওয়ার যে দাবি, সে নিয়ে পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়ার তুলনা করে দেখুন।"
"আজহারকে আন্তর্জাতিক জঙ্গি হিসেবে ঘোষণা করার ব্যাপারে চিনের অবস্থান হলো, এ ব্যাপারে যথেষ্ট প্রমাণ নেই। তবে পি৫-এর অন্যান্য সদস্যদের এ ব্যাপারে অন্যরকম মতামত রয়েছে। এ ধরনের সংগঠনগুলির সঙ্গে চিনের একটি বোঝাপড়া রয়েছে, যে আমাদের বিরক্ত কোর না, আমরাও তোমাদের ঘাঁটাব না। তোমরা যদি আন্তর্জাতিক ভিত্তি বৃদ্ধি করতে চাও, তাহলে তা আমার উপর ভর ক'রে করা যাবে না। এটাই চিনের এখনকার দৃষ্টিভঙ্গি," বললেন কোন্ডাপল্লী।
পাকিস্তানের রাস্তাঘাটেও চিনের জনপ্রিয়তা প্রভূত। সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, ৮৮ শতাংশ পাকিস্তানি চিনের পক্ষে, সেখানে ভারতের পক্ষে মাত্র ৩৩ শতাংশ। আজহার নিয়ে ভারতের দাবিকে সমর্থন করতে গিয়ে সে জনপ্রিয়তায় ভাঁটা পড়ুক, তেমনটাও চায় না চিন। ২০১১ সালে ওসামা বিন লাদেন হত্যা এবং তার আগে, ২০০২ সালে মার্কিন ইজরায়েলি সাংবাদিক ড্যানিয়েল পার্ল হত্যার ঘটনার সাপেক্ষে আমেরিকা-পাকিস্তান সম্পর্কের ব্যাপারেও চিন যথেষ্ট সচেতন।
প্রতিযোগী হিসেবে ভারতের উত্থানও কি আজহারের ব্যাপারে চিনের সিদ্ধান্তের কারণ হতে পারে?
হ্যাঁ। যে সামান্য কয়েকটি অর্থনৈতিক ক্ষমতাবান দেশ BRI-তে যোগ দেওয়ার ব্যাপারে সিপেক নিয়ে নয়া দিল্লি দীর্ঘ আপত্তি জানিয়েছে, কারণ সে পথ যাচ্ছে পাক অধিকৃত কাশ্মীরের মধ্যে দিয়ে। পাকিস্তানের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ভারতকে এনএসজি-তে ঢুকতে না দেওয়া এবং আজহার নিয়েও পাকিস্তানের সঙ্গ দেওয়ার মাধ্যমে ভারতকে খোঁচা দিতে চেয়েছে চিন। বার্তা দিতে চেয়েছে আমেরিকাকেও, যে আমেরিকা চিনকে আটকাতে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করতে চলেছে।
চিনের অবস্থান কি সবসময়ে এরকমই থেকেছে?
আজহারের আগে জামাত-উদ-দাওয়া প্রধান হাফিজ সইদকে আন্তর্জাতিক জঙ্গি হিসেবে ঘোষণার ভারতীয় দাবি উড়িয়ে দিয়েছিল চিন। কিন্তু ২০০৮ সালে ২৬/১১ হামলার পর পরিস্থিতি বদলে যায়, সারা দুনিয়ার চাপের মুখে অবস্থান বদলাতে হয় চিনকে। কিন্তু ২৬/১১-র হামলা ছিল একেবারেই পৃথক মাত্রার ঘটনা। পুলওয়ামার ঘটনার পর আজহার নিয়ে চিনের উপর আন্তর্জাতিক চাপ কতটা বাড়ে, এখন সেটাই দেখার।
আজহার অবস্থান কি চিনের ক্ষেত্রে সমস্যার হতে পারে?
ভারত- চিন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সম্ভবত তেমনটা হবে না। তবে জনমতের একটা বদল ঘটতে পারে, যা চিনকে মেনে নিতেও হবে। অধ্যাপক কোন্ডাপল্লির মতে ”এবার সত্যিই আর আড়াল করার অবস্থা নেই... জৈশ বলে দিয়েছে যে এ ঘটনায় তারা যুক্ত। চিনের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং ভারতের মানুষ চিনকে আরও খারাপ চোখে দেখবে।”
গত বছর ডিসেম্বরে ভারতে এসেছিলেন চিনের বিদেশমন্ত্রী ওয়াং উয়ি। উচ্চপর্যায়ের সে সফরে ছিল সাংস্কৃতিক বিনিময় কর্মসূচিও। অধ্যাপক কোন্ডাপল্লি বললেন, ”ওরা টিনের গল্প বলে ভারতের বাজার ধরতে চায়... গোটা ব্যাপারটা বুমেরাং হতে পারে। কূটনীতিতে এ হয়ত চোখে দেখা যায় না, কিন্তু ব্যাপারটা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।”
ভারত যদি সরাসরি চিনের বিরুদ্ধে না-ও দাঁড়ায়, এ ব্যাপারে আমেরিকাকে অনুসরণ করে হুয়াওয়ের মত চিনা কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে তারা। ”এর ফলে ভারত-চিন সম্পর্কে প্রভাব পড়বে না, কিন্তু চিন নিয়ে ভারতে কথাবার্তার পরিমাণ কমবে। নেতিবাচক জনমতের কারণে বেশ কিছু কোম্পানির উপরে বিধিনিষেধ আরোপ করা যেতে পারে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যেমন করেছিলেন।”
Read the Full Story in English