করোনা মহামারীর কারণে প্রায় দু বছরের বেশি সময় ধরে বন্ধ হয়ে রয়েছে স্কুল কলেজ সহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কিন্তু আর কতদিন, স্কুল বন্ধ থাকলে তা যে কেবল মাত্র শিশুদের ওপর প্রভাব ফেলবে এমনটা নয়। জাতীয় অর্থনীতিতেও এর প্রভাব পড়তে বাধ্য সতর্ক করেছে বিশ্বব্যাঙ্ক। এবং অবিলম্বে স্কুল খোলার পরামর্শ দিয়েছে। এখন প্রশ্ন হল কবে থেকে আবার স্বাভাবিক হবে পঠনপাঠন। স্কুল খোলার গুরুত্ব অনুধাবন করে টিচ ফর ইন্ডিয়া, একটি ভারতীয় বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) বোস্টন কনসাল্টিং গ্রুপ, ইউনাইটেড স্টেট অফ আমেরিকার পরামর্শক সংস্থার সঙ্গে যৌথভাবে একটি গবেষণা চালিয়েছে। গবেষণার মূল বিষয় 'ইন্ডিয়া নিডস টু লার্ন’ কেন স্কুলগুলি অবিলম্বে খোলা গুরুত্বপূর্ণ? এই বিষয়ে যে রিসার্চ করা হয়েছে তাতে কতগুলি বিষয় সামনে এসেছে। সমীক্ষা অনুসারে, ৯০% শিশু অন্তত একটি নির্দিষ্ট ভাষা ক্ষমতা হারিয়েছে। বিশ্বব্যাংকের গবেষণা পরামর্শ দেয় যে প্রতি বছর স্কুলে পড়ালেখা হারানোর ফলে একজন শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ আয়ের পরিমাণ ৯% কম হতে পারে যা ভবিষ্যতের জিডিপিতে বিধ্বংসী প্রভাব ফেলবে। "ভারতকে শিখতে হবে - স্কুল খোলা রাখার প্রয়োজনীয়তা” প্রতিবেদনটি এই গবেষণার মূল ফলাফলগুলি এবং ভারতকে আরও ভালভাবে গড়ে তোলার জন্য স্কুল খোলার প্রয়োজনীয়তাগুলিকে তুলে ধরে।
সারা বিশ্বের নিরিখে দেখা গেছে কোভিডের প্রথম ঢেউকালে প্রায় সব দেশ স্কুল কলেজ বন্ধ রাখলেও পরবর্তীতে সেগুলি খোলা রেখেছে। জাপান, দক্ষিণ আফ্রিকা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, পর্তুগাল সহ একাধিক দেশ ২০২১ সালে তাদের দেশের স্কুল কলেজ সহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে চালু রেখেছে। প্রকৃতপক্ষে, অনেক দেশ মল, দোকান, জিম (যেমন, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সিঙ্গাপুর) থেকে স্কুল খোলা রাখাকে অগ্রাধিকার দিয়েছিল। বিসিজি ডিরেক্টর সীমা বনসাল জানিয়েছেন, ভারতের ৫ টি রাজ্যে অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থা শহর এবং গ্রামাঞ্চলের মধ্যে শিক্ষার তারতম্যকে ব্যাপকভাবে তুলে ধরেছে। শহরের ছেলেমেয়েদের থেকে গ্রামের ছেলেমেয়েরা অনলাইন পঠন পাঠনের ক্ষেত্রে অনেকাংশেই পিছিয়ে যা প্রত্যক্ষ প্রভাব ফেলছে শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর। ভারতে রেস্তোরাঁ, মল, জিম স্যালন, পার্লার খোলা রাখা হলেও কেন বন্ধ রাখা হয়েছে স্কুল সেই প্রশ্ন বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে।
কোভিড ১৯ কালে স্কুল খোলায় কী বড় প্রভাব পড়তে পারে শিশুস্বাস্থ্যের ওপর?
প্রথমত প্রতিবেদন অনুসারে দেখা যায় যে, কোভিড ১৯ এ শিশুদের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভবনা অনেক কম সেই সঙ্গে ১৫ থেকে ১৮ বছর বয়সীদের ইতিমধ্যেই টিকাদানের কাজও শুরু হয়ে গেছে। দেখা গেছে, শিশুরা তুলনায় অনেক কম করোনা ভাইরাস দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। বা তারা করোনা আক্রান্ত হলেও ৯৫ শতাংশের ক্ষেত্রে তার প্রভাব খুব সামান্য পড়েছে। কোভিডের আক্রান্ত হয়ে শিশুমৃত্যুর ঘটনাও তেমন ব্যপক ভাবে সামনে আসেনি। দ্বিতীয়ত, ২০২১ সালের মাঝামাঝি ভারতের নির্বাচিত রাজ্যগুলিতে স্কুল পুনরায় চালু হওয়া সত্ত্বেও, স্কুলগুলিতে কম সংক্রমণের ইঙ্গিত দিয়েছে । পাঞ্জাব, মহারাষ্ট্র সহ যে সকল রাজ্যে স্কুল খোলা হয়েছিল সেই সকল রাজ্যে স্কুল খোলার কারণে কোভিড কেস বৃদ্ধি পায়নি। তৃতীয়ত, টিকাদানের আগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে স্কুল গুলিকেও খোলা রাখা উচিত। কারণ অধিকাংশ স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকা ইতিমধ্যেই টিকা নিয়েছেন। সেই সঙ্গে টিকা দানের কাজ চলছে ১৫ থেকে ১৮ বছর বয়সীদেরও তাই এক্ষেত্রে স্কুল বন্ধ রাখার সেভাবে কোন যৌক্তিকতা নেই বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ভারতের ক্ষেত্রে দেখা গেছে অনেক জেলায় সংক্রমণের মাত্রা অনেক কম থাকলেও রাজ্যে যেহেতু বিধিনিষেধ জারি রয়েছে তার গেরোয় পড়ে খোলা যায়নি স্কুল গুলি।
করোনা সময়কালীন দীর্ঘদিন বন্ধ মিড-ডে মিল
OXFAM সমীক্ষা অনুসারে ৩৫% শিশু স্কুল বন্ধের কারণে দুপুরের খাবার থেকে বঞ্চিত হয়েছে যা সম্ভাব্যভাবে ভারতে শিশুদের অপুষ্টির একটি অন্যতম কারণ হতে পারে। স্কুল বন্ধের কারণে বেড়েছে শিশুশ্রম, সেই সঙ্গে বেড়েছে স্কুল ছুট পড়ুয়ার সংখ্যাও। সেই সঙ্গে ব্যহত হচ্ছে শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য মনে করছেন বিসিজির অন্যতম পরামর্শদাতা দিক্ষা বাহল । সেই সঙ্গে শিক্ষাক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয়কে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে যেমন বলা হয়েছে পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ানো (যেমন, সাপ্তাহিক অ্যান্টিজেন পরীক্ষা), টিকাকরণ (যেমন, স্কুলের কর্মীদের জন্য বাধ্যতামূলক), নিরাপত্তা প্রোটোকল (যেমন, মাস্কিং ইত্যাদি) এবং পর্যাপ্ত বাতাস চলাচল (যেমন, বাইরের জায়গার সুবিধা, বায়ুচলাচল মনিটর) সেই সঙ্গে বলা হয়েছে এই দুবছরের যে বিরতি, এর থেকে শিশুদের মুক্ত করে আনতে প্রয়োজন ক্যাচ আপ প্রোগ্রাম। শাহিন মিস্ত্রি (সিইও, টিচ ফর ইন্ডিয়া) বলেছেন "করোনাকালে শিক্ষাব্যবস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ব্যাঘাত ঘটছে শিশুদের পড়াশুনায়, যেখানে দেশব্যাপী স্কুলগুলি মূলত সমস্ত শিশুদের জন্য বন্ধ রয়েছে, এটি একটি বিশাল প্রভাব ফেলেছে শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর”। অবিলম্বে স্কুল খোলা সেই সঙ্গে শিশুদের শিক্ষা ক্ষেত্রে খাপ খাইয়ে নেওয়ার মত পরিকাঠামো গড়ে তোলা একান্তভাবেই প্রয়োজন।