আরএসএস মানেই 'নারী বিদ্বেষী'। কয়েক দশক ধরে এই তকমায় জেরবার রাষ্ট্রীয় সয়ং সেবক সংঘ। লোকসভায় মোদী সরকারের নেতৃত্বে সদ্য পেশ হয়েছে মহিলা সংরক্ষণ বিল। বহু প্রতিক্ষিত এই বিলের হাত ধরেই নিজেদের সংগঠনের সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়া নেতিবাচক তকমা ঘোচাতে মরিয়া আরএসএস। ইতিমধ্যেই ওই বিলকে সমর্থন জানিয়েছে সংগঠনটি। অনুসারী সব সংগঠনের সঙ্গে বৈঠক করে আরএসএস কর্তারা মহিলা সংরক্ষণ বিলের গুরুত্ব বোঝাচ্ছেন।
তবে, এই প্রয়াস সদ্য নয়। বর্তমান আর্ত সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পর্যালোচনা ও নারী ক্ষমতায়ণের বিষয়টি বিবেচনা করে বিগত বেশ কয়েক বছর ধরেই এই প্রয়াস চালাচ্ছে 'হিন্দুত্ববাদী' এই সংগঠনটি।
২০২২ সালের অক্টোবরে বিজয়া দশমীর অনুষ্ঠানে বক্তব্যে রাখতে গিয়ে আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত বলেছিলেন, 'পুরুষ যেসব কাজ করে তা মহিলারা পারে না। ২০১৭ সাল থেকে একটি সমাক্ষায় এমন কিছুই উঠে আসেনি। আমাদের সমাজে ৫০শতাংশ মাতৃশক্তি। এটাকে উপেক্ষা করা যায় না। আমরা হয় তাদের প্রার্থনা কক্ষে তালাবদ্ধ করে রাখি, নয়তো দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসাবে চিহ্নিত করে ঘরে বন্ধ করে দিয়ে রাখি। এই মানসিকতা দূর হওয়া প্রয়োজন। যদি সমগ্র সমাজকে সংগঠিত করতে হয় তবে সর্বক্ষেত্রে নারীদের সমানাধিকার দিতে হবে। কোনও বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণেও তাঁদের স্বাধীনতা দিতে হবে।'
শুধু মুখের কথা নয়। কার্যক্ষেত্রেও নানা পদক্ষেপে বদলের ইঙ্গিত দিয়েছে আরএসএস। আরএসএসের বিজয়া দশমীর সেই অনুষ্ঠানেই প্রধান অতিথি ছিলেন ইন্দো-তিব্বত সীমান্ত বাহিনীর অফিসার তথা পর্বতারোহী সন্তোষ যাদব। এই প্রথম বিজয়া দশমীর অনুষ্ঠানে আরএসএসের কোনও মহিলাকে প্রধান অতিথি'র মতো মর্যাদা দিয়েছিল।
চলতি বছর মার্চে অখিল ভারতীয় প্রতিনিধি সভা জানিয়েছিল যে, আরএসেএসে চোখে পড়ার মত করে মহিলা সদস্যের সংখ্যা বৃদ্ধিতে জোর দেওয়া হয়েছে। আরএসএস সাধারণ সম্পাদক (সংগঠন) দত্তাত্রেয় হোসাবালে বলেছিলেন, 'সংঘের অনেক কর্মসূচি যেমন কুটুম্ব প্রবোধন, সেবা বিভাগ এবং প্রচার বিভাগ নারীদের অংশগ্রহণ ছাড়া সফল হতে পারে না। আমরা এই বৈঠকে সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, গ্রাম ও শহরে আমাদের গৃহস্থ স্বয়ংসেবকদের (বিবাহিত আরএসএস কর্মী) দ্বারা প্রতি তিন মাস অন্তর একটি পারিবারিক শাখার আয়োজন করা হবে এবং মহিলাদের অংশগ্রহণে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে।'
দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী ক্ষমতায়ণ সংক্রান্ত এক আলোচনায় অগাস্টেই আরএসএসের যুগ্ম সম্পাদক কৃষ্ণ গোপাল বলেছিলেন, 'জনজীবনে নারীদের অংশগ্রহণের অভাব ভারতীয় সংস্কৃতির অংশ ছিল না। এটা ইসলামিক আগ্রাসনের ফল। বাল্যবিবাহ, সতীদাহ, বিধবা বিবাহের উপর নিষেধাজ্ঞা এবং নারীর নিরক্ষরতার মত প্রথাগুলি ভারতীয় সমাজে ইসলাম আগ্রাসনের কারণে ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে। তার আগে এ দেশে নারীরা যুক্তিসঙ্গত কারণেই স্বাধীন ছিলেন এবং ভারতীয় সমাজে উল্লেখযোগ্যভাবে অবদান রেখেছিলেন।'
প্রাচীন ভারতীয় সমাজে মহিলাদের উচ্চ মর্যাদা সম্পর্কে বলতে গিয়ে, কৃষ্ণ গোপাল বলেছিলেন যে 'ঋকবেদে ২৭ জন মহিলা স্তোত্র পাঠ করেছেন এবং মহাভারতের দ্রৌপদী সব মহিলাদের জন্য অনুপ্রেরণা। দ্রৌপদীকে যাঁরা অপমান করেছিলেন তাঁদের ধ্বংসের কারণ ছিলেন।'
১৮ সেপ্টেম্বর সংসদের বিশেষ অধিবেশন শুরু হওয়ার দু'দিন আগে, অনুগামী ৩৬টি সংস্থার সঙ্গে বার্ষিক সমন্বয় সভা করেন আরএসএসের কর্তারা। আরএসএস যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মনমোহন বৈদ্য সেখানে বলেছিলেন যে 'আরএসএস-অনুপ্রাণিত সংস্থাগুলি সমস্ত ক্ষেত্রে মহিলাদের অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্য এবং তাঁদের অগ্রণী ভূমিকা নিশ্চিত করতে বিশেষ প্রচেষ্টা করবে।' সেখানেই তিনি বলেছিলেন যে, 'পরিবারে নারীর ভূমিকা সবচেয়ে বেশি ও গুরুত্বপূর্ণ। তাই সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীদের অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। সমাজে নারীদের ক্রমবর্ধমান সক্রিয়তা প্রশংসনীয়।'
বৈদ্য বলেছেন যে বৈঠকে আরএসএসের শতবর্ষে মহিলাদের অংশগ্রহণের বিষয়ে বিশদভাবে আলোচনা করা হয়েছে। সংগঠনে মহিলাদের জন্য দেশজুড়ে ৪১১টি সম্মেলন আয়োজন করা হবে। আরএসএস এ পর্যন্ত ৭৩টি এই ধরণের সম্মেলন করেছে। সেখানে ১.২৩ লাখেরও বেশি মহিলা অংশগ্রহণ করেছে।
অতি সম্প্রতি আরএসএসের ছাত্র শাখা অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনের জন্য একটি 'মহিলা ম্যানিফেস্টো' প্রকাশ করেছে৷ ইস্তেহারে মেয়েদের জন্য হোস্টেল, মহিলাদের আত্মরক্ষা প্রশিক্ষণের জন্য মিশন সাহসি'র মত উদ্যোগের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে৷ সেখানে মেয়েদের স্যানিটারি ন্যাপকিন বিতরণের জন্য রিতুমতি অভিযানেরও উল্লেখ রয়েছে।