দিল্লি বিধানসভা ভোটের প্রচারে শাহিনবাগ নিয়ে বহু কথা হয়েছে। ভোটের ফলের দিন, শাহিন বাগ নিজস্ব ঢংয়ে একটাই বার্তা দিল- মৌনতা।
১১ ফেব্রুয়ারির সকালে রাস্তা দিয়ে শাহিনবাগমুখী জনতার হাতের প্ল্যাকার্ডে লেখা - আজকের বিক্ষোভ মৌন। আমরা কোনও রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করি না। টিভি কর্মীরা যখন ক্যামেরা নিয়ে সেখানে পৌঁছন, তখন তাঁদের দেখিয়ে দেওয়া হয় সেই প্ল্যাকার্ড। একটু, একবারটি কিছু বলার অনুরোধও দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়।
তাঁবুর ভেতরে মহিলারা সার দিয়ে বসেছিলেন, তাঁদের হাতেও একই প্ল্যাকার্ড। "আজ মৌন বিক্ষোভ। আমরা পুলিশি বর্বরতার বিরুদ্ধে। আমরা কোনও রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করি না।"
সংবাদকর্মীদের দিকে এগিয়ে এসে একজন বললেন, "আপনারা ছবি তুলতে পারেন। কিন্তু বিক্ষোভকারীরা আজ কেউ কথা বলবেন না।" কিন্তু কেন! "কারণ শব্দ নিয়ে এদিক ওদিক করা যায়। এ বিক্ষোভ কোনও রাজনৈতিক দলকে সমর্থন বা বিরোধিতার জন্য নয়। আমরা কাউকে ভুল বার্তা দিতে চাই না। জয়ী বা বিজিত, কোনও পক্ষকেই আমাদের ব্যবহার করতে দেব না।"
ভেতরে একটু অন্যরকম। দুটি মেয়ে ঝগড়া করছে। "আমি ওকে সরতেও বলতে পারব না! আমাকে সেটা তো বলতে হবে।" তাকে দ্রুত থামিয়ে দেওয়া হয়। অনেক মহিলারা ফোনে খবরের চ্যানেল চালিয়ে রেখেছেন, তবে মিউট করা।
বাইরে দলে দলে লোক জড়ো হচ্ছেন। এরকমই একদল ফোনে ভোটের ফল দেখছিলেন। স্থানীয় বাসিন্দা মহম্মদ ওয়াসিম বললেন, "খুব ভাল হয়েছে বিক্ষোভকারীরা আজ কথা বলছেন না। আমাদের আন্দোলনের সঙ্গে কোনও রাজনৈতিক দলের যোগ নেই। কোনও রাজনীতিবিদ আমাদের সপক্ষে কথা বলেননি। একটা গণতন্ত্রে আমাদের কাউকে না কাউকে ভোট দিতে হয়। কিন্তু তার মানে এই নয়, সে দলের সব কিছু আমরা সমর্থন করি।"
ভোটের ফল নিয়ে শঙ্কা রয়েছে! ওয়াসিমের পাশে দাঁড়ানো শায়িন বললেন, "গণতন্ত্রের নাগরিক হিসেবে আমরা উদ্বিগ্ন। সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক দলটি একদল নাগরিকের মূল বিপক্ষ। আমরা কোনও না কোনও ভাবে আগুনের নিচে। কিন্তু যদি এ ধরনের রাজনীতির জয় হয়, তাহলে সকলেরই উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত।"
ওয়াসিমকে আজকাল নিয়মিত থানায় হাজিরা দিতে হয়। "আমি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছিলাম, ওরা টিভিতে আমাকে দেখিয়েছে। পুলিশ বোধহয় তা থেকেই আমাদের চিনতে পেরেছে। কিন্তু আমাদের কিছু লুকোনোর নেই। আমরা কিছু ভুল করছি না, থানায় রিপোর্ট করতে আমার কোনও অসুবিধা নেই।"
ওয়াসিমের তুতো বোনের বয়স ১৪। গতকাল জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ার বিক্ষোভে মারধর করা হয়েছে। তার নাম খুশবু। সে বলে, "হ্যাঁ পুলিশ আমার হাত মুচড়ে দিয়েছে। ধাক্কায় আমি পড়ে গিয়েছিলাম, পায়ে ব্যথা পেয়েছি। কিন্তু আমি আবার জামিয়া যাব, এখানেও আসব।"
খুশবুর বন্ধু জোয়া একটু শান্ত। সে বলে, "আমার আশা আজকের ভোটের ফলে বিজেপি বুঝতে পারবে দিল্লির মানুষ আমাদের সম্পর্কে কী ভাবে।"
একটু দূরের এক চায়ের দোকানে জড়ো হয়ে কিছু লোক ভোটের ফল দেখছিলেন। চা বিক্রেতা বলেন, "বিজেপি জিতবে, আমি লিখে দিচ্ছি।" এক খরিদ্দার হেসে বলেন, "ও তুকতাক করছে, যাতে রেজাল্ট অন্যরকম না হয়।"
২২ বছরের ফজল বলেন, "বিজেপি হারবে। অমিত শাহের ধারণা ও বাহুবলীর ছেলে, কিন্তু লোক ওকে দেখিয়ে দেবে।" চা বিক্রেতা চোখ ঘুরিয়ে বলেন, "ওর জন্যই বিক্ষোভকারীরদের আজ চুপ থাকতে বলা হয়েছে।"
কেজরিওয়াল তো একদিনও বিক্ষোভের সমর্থনে বলেননি। বিজেপি যে ক্রমাগত টার্গেটকরে গেছে, তার বিরুদ্ধেও মুখ খোলেননি। জনতা তা নিয়ে ক্ষুব্ধ নয়?
মুকির কথায়, "কেজরিওয়াল খুব চালাক। আমরা বুঝি। আর উনি দিল্লির জন্য প্রচুর করেছেন। দিনের শেষে লোকে সরকারের কাছ থেকে তো সেটাই চায়।" সমীর খান বলেন, "ক্যা আর এনআরসি তো রাজ্য সরকারের ব্যাপার নয়। ভালই হয়েছে যে আন্দোলনের সঙ্গে ওঁর কোনও যোগ নেই, সেখান থেকে উনি ফায়দা তোলার চেষ্টা করেননি।"
হঠাৎ কেউ বলে ওঠে শাহিনবাগ এলাকার বিধানসভা কেন্দ্র ওখলায় আমানাতুল্লা খান পিছিয়ে। জুবের বলেন, "বিজেপি কোনওদিন এখান থেকে জিতবে না। আর সেটা ওরাই তৈরি করেছে, আমরা নই।"
তাঁবুর ভিতরে আরও মানুষ জমে ওঠে। মহিলাদের পাশে জড়ো হন পুরুষরাও। এবার শুধু প্ল্যাকার্ড নয়, মুখে কালো কাপড় বাঁধা। এক কোণে তৈরি হচ্ছে আরও প্ল্যাকার্ড। ফোন সরিয়ে রাখা হয়েছে। সকালের চেয়ে পরিবেশ এখন অনেকটাই শান্ত। সাংবাদিকদের প্রতিটি প্রচেষ্টা মাঠে মারা যাচ্ছে। একজন একটি পোস্টকার্ড তুলে ধরেন, তাতে লেখা "আমাদের লড়াই একটা ভোটের নয়। দয়া করে বুঝুন।"
বাইরের দিকে এতটা কঠোর নয় ব্যাপারটা। জাতীয় পতাকা বিক্রি করা ছেলেটা জিজ্ঞাসা করে, "কেজরিওয়াল ফিরছে?" হ্যাঁ বাচক উত্তরে সে খুশি হয়ে ওঠে।
ছেলেটার কথার উত্তর দিয়েছিলেন মহম্মদ সমীর। তিনি বলেন, "কেজরিওয়াল অন্তত মানুষের মধ্যে বিভাজনের চেষ্টা করেননি। উনি যা করেছেন, সব মানুষের জন্য। বিজেপি মুসলিমদের শত্রু হিসেবে ঘোষণা করেছে। ওরা বোঝে না এতে দেশের ক্ষতি হবে?"
ততক্ষণে একদল লোক জড়ো হয়ে গিয়েছেন। বয়স্ক একজন জিজ্ঞাসা করেন, "একটা প্রচারের কথাও বলতে পারবেন, যেখানে একদল লোককে ক্রমাগত আক্রমণ করে যাওয়া হয়নি? রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের চেয়ে তো বেশি আমাদের সঙ্গে লড়ছে বিজেপি।"
মহম্মদ কাফিল বলেন, "মুসলিম ভোট খুব সহজে জেতা যায়। আমাদের জন্য কেউ কিছু করেনি। যদি কেউ বলে আমাদের জন্য তাদের কিছু এসে য়ায়, আমরা তাকেই ভোট দেব। মুসলিমরা বিজেপির বিরুদ্ধে যায়নি। বিজেপি ঠিক করেছে তারা মুসলিমদের বিরুদ্ধে।"
এ সময়েই একজন তাঁবু থেকে বেরিয়ে আসেন। তিনি মৌন বিক্ষোভ প্ল্যাকার্ডের দিকে আঙুল দেখান। লজ্জিত মুখে জনতা নিমেষে ছ্ত্রভঙ্গ হয়ে যায়।