করোনাভাইরাস মহামারীর আবহেই জারি হলো আরও এক সম্ভাব্য স্বাস্থ্য সঙ্কটের সতর্কবার্তা। ইউনাইটেড নেশনস চিলড্রেনস ফান্ড (UN Children’s Fund বা UNICEF) জানিয়েছে, বিশ্ব জুড়ে COVID-19 লকডাউনের ফলে বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায় শিশুদের টীকাকরণ প্রক্রিয়া অসম্পূর্ণ বা আংশিক ভাবে সম্পূর্ণ থেকে যাচ্ছে, যার ফলে ঘনিয়ে আসতে পারে ঘোর বিপর্যয়। উল্লেখ্য, এই সম্ভাব্য সঙ্কটের শিকার হতে পারে যেসব শিশু, তাদের মধ্যে প্রায় ৪৫ লক্ষের বাস ভারত, পাকিস্তান, এবং আফগানিস্তানে।
হাম, ডিপথেরিয়া সমেত টীকার দ্বারা প্রতিরোধ করা যায় এমন কিছু অসুখের বিক্ষিপ্ত প্রাদুর্ভাব ইতিমধ্যেই দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, এবং নেপালের বেশ কিছু অংশে, জানিয়েছে UNICEF। আন্তর্জাতিক এই সংস্থার তরফে জানানো হয়েছে, "নভেল করোনাভাইরাস প্রতিরোধে লকডাউনের জেরে ব্যাপক হারে ব্যাহত হয়েছে রুটিনমাফিক টীকাকরণ প্রকল্প, এবং ক্রমশই তাঁদের সন্তানদের টীকা দেওয়াতে হেলথ সেন্টারে নিয়ে যেতে অনিচ্ছুক হয়ে পড়ছেন বাবা-মায়েরা।"
UNICEF-এর হিসাব অনুসারে, টীকাকরণ আদৌ হয় নি, অথবা আংশিকভাবে হয়েছে, এমন ৪৫ লক্ষ শিশু রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ায়, যা বিশ্বের মোট সংখ্যার প্রায় এক-চতুর্থাংশ। এদের মধ্যে ৯৭ শতাংশেরই বাস ভারত, পাকিস্তান, এবং আফগানিস্তানে।
আরও পড়ুন: শিশুদের মধ্যে কোভিড জাতীয় সংক্রমণ নিয়ে ইউরোপে উদ্বেগের কারণ কী?
পাকিস্তান, এবং আফগানিস্তানের ক্ষেত্রে একটি বাড়তি বিপদ হলো, এগুলি পৃথিবীর শেষ কয়েকটি পোলিও-কবলিত দেশের মধ্যে দুটি। UNICEF-এর দক্ষিণ এশিয়া দফতরের (Regional Office for South Asia বা ROSA) আঞ্চলিক স্বাস্থ্য উপদেষ্টা পল রাটার বলেন, "বিমান চলাচল এবং সাধারণ যাতায়াতের ওপর নিষেধাজ্ঞার ফলে সরবরাহ শৃঙ্খল ব্যাহত হয়েছে, যে কারণে এই অঞ্চলের কিছু দেশে বিপজ্জনকভাবে কমে এসেছে ভ্যাকসিনের স্টক। ভ্যাকসিনের উৎপাদনেও ভাটা পড়েছে, যার ফলে আরও অভাব দেখা দিয়েছে।"
রাটার আরও বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার অজস্র স্বাস্থ্যকেন্দ্র, যেখানে লক্ষ লক্ষ শিশুর টীকাকরণ হয়ে থাকে, সেগুলি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে টীকা দেওয়ার কাজও একরকম বন্ধই। তাঁর কথায়, "সম্মুখ সারির স্বাস্থ্যকর্মীরা যতক্ষণ পর্যন্ত প্রয়োজনীয় সতর্কতা বিধি মেনে চলছেন, বিশেষ করে হাত ধোওয়া সংক্রান্ত বিধি, ততক্ষণ তাঁদের দিয়ে টীকা না দেওয়ানোর কোনও কারণ নেই। বরং টীকাকরণ চলতে দেওয়াটা অতি আবশ্যক।"
রাষ্ট্রীয় গণ টীকাকরণ প্রক্রিয়া স্থগিত রাখা হয়েছে এই অঞ্চলের একাধিক দেশে। বাংলাদেশ এবং নেপাল স্থগিত রেখেছে তাদের হাম (মিজলস) এবং রুবেলা (জার্মান হাম) উচ্ছেদ অভিযান, আবার পাকিস্তান ও বাংলাদেশে আপাতত বন্ধ রয়েছে পোলিও অভিযান। ভারতে সরকারি ভাবে এখনও কোনও ঘোষণা না হলেও বহু জায়গা থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে টীকাকরণ প্রক্রিয়া বন্ধ হওয়ার খবর আসছে।
UNICEF-এর জোর সুপারিশ, যেখানে যেখানে টীকাকরণ প্রক্রিয়া বন্ধ রয়েছে, সেখানে সরকার যেন COVID-19 জনিত লকডাউন ওঠামাত্রই দ্বিগুণ তৎপরতায় ফের এই প্রক্রিয়া চালু করে। এবং সেই উদ্দেশ্যে পুঙ্খানুপুঙ্খ পরিকল্পনা নেওয়া উচিত এখন থেকেই।
আরও পড়ুন: লকডাউনের শেষ সপ্তাহ, সামনে এখন কঠিন চ্যালেঞ্জ
ROSA-র অধিকর্তা জিন গফ বলেছেন, "শিশুদের টীকা না দেওয়ার প্রভাব সম্পর্কে আমরা অত্যন্ত বেশিরকম চিন্তিত। এদের মধ্যে অধিকাংশ শিশু এমনিতেই ঝুঁকিপ্রবণ। COVID-19 ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে শিশুদের গুরুতর অসুস্থতার কোনও খবর এখনও নেই, তবে নিয়মমাফিক ভ্যাকসিন পরিষেবা ব্যাহত হলে লক্ষ লক্ষ শিশু ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এটা অত্যন্ত বড় রকমের ঝুঁকি। আগেভাগে পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।"
অন্যদিকে, বিশ্ব খাদ্য প্রকল্প (World Food Programme বা WFP) এবং UNICEF যৌথভাবে সমস্ত সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছে, যেন স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে স্কুলের দেওয়া খাবার থেকে বঞ্চিত না হয় পৃথিবীর ৩৭ কোটি শিশু, অন্যথা তাদের স্বাস্থ্য এবং পুষ্টির ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়বে। পৃথিবীর কোটি কোটি শিশুর ক্ষেত্রে স্কুলে পরিবেশিত খাবারই ছিল তাদের সারাদিনের খোরাক।
পৃথিবীর ৬৮টি দেশে সরকার এবং WFP-র তরফে পড়ুয়াদের মধ্যে রেশন বিলি করা হচ্ছে যা তারা বাড়ি নিয়ে যেতে পারে, বা 'স্কুল মিল'-এর পরিবর্তে মিলছে ভাউচার বা নগদ টাকা। স্কুল খুললে যাতে খাদ্য পরিবেশন ফের দ্রুত চালু করা যায়, সেই উদ্দেশ্যে সাহায্যের আবেদনও জানিয়েছে WFP এবং UNICEF।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন