কলেজে ভর্তি আর মাছ-সবজির বাজারের মধ্য়ে কোনও পার্থক্য় বোধহয় সত্যিই রইল না। ঝিঙে ৩০, আলু ২০, রুই-কাৎলা ১৮০-২০০, ট্য়াংরা ৬০০। যার যেমন দর, সেভাবে হাঁকেন সবজি-মাছ বিক্রেতারা। এখন কলকাতার কলেজগুলোতে এই ধরনেরই হাঁকাহাঁকি চলছে। যাঁর যেমন টাকার জোর, তিনি সেই অনুযায়ী বিষয় বা সাবজেক্ট কিনতে পারবেন। বাংলা, ইংরেজী ১৩,০০০ টাকা, জার্নালিজম, বোটানি, ফিলোজফি ২৫,০০০, জুলজি, জিওগ্রাফী, মাইক্রোবায়োলজি ৫০,০০০। এভাবে নাকি বিষয়-ভিত্তিক রেট বেঁধে দেওয়া হয়েছে। ছাত্র-ছাত্রীদের হাতে হাতে ঘুরছে এই দামের তালিকা। কলকাতার প্রায় সব কলেজে কমবেশি এই রেট লাগু হয়েছে। ভর্তির ফি-এর বাইরেও এই টাকা দিতে হবে 'দাদাদের'। এটাই নাকি অলিখিত নিয়ম হয়ে গিয়েছে। এই অভিযোগ করছে একাধিক ছাত্র সংগঠন।
ভর্তির অনেকগুলি 'রেট চার্টের' মধ্যে একটি। আমরা এখনো এর সত্যতা যাচাই করতে পারি নি।
এই প্রেক্ষিতেই কলেজে কলেজে অনলাইন ভর্তি নিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে বৃহত্তর আন্দোলনে নামতে চলেছে রাজ্য়ের বেশ কিছু বিরোধী ছাত্র সংগঠন। তাদের দাবি, ফের কেন্দ্রীয় অনলাইন পদ্ধতি চালু হোক। একইসঙ্গে, আবেদন থেকে ভর্তির টাকা জমা নেওয়া, সবই হোক অনলাইনে। অ্য়ানালগ পদ্ধতি পুরোপুরি বন্ধ করতে হবে। তাদের মতে, যতদিন কলেজ সরাসরি ভর্তির সঙ্গে যুক্ত থাকবে ততদিন টাকা নিয়ে ভর্তি আটকানো সম্ভব নয়।
অবস্থা এতটাই সঙ্গীন যে ছাত্রছাত্রী ভর্তি বিষয়ে 'তোলাবাজি' নিয়ে আসরে নামতে বাধ্য় হয়েছে খোদ কলকাতা পুলিশও। আজ সন্ধ্যায় একটি ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে কলকাতা পুলিশ একটি ই-মেল আইডি এবং দুটি হ্য়োয়াট্স অ্য়াপ নাম্বারে জনসাধারণকে কলেজে ভর্তি-জনিত কোনোরকম অভিযোগ থাকলে তা জানানোর আবেদন করেছে। যাঁরা অভিযোগ করবেন তাঁদের নাম গোপন রাখা হবে বলেও জানানো হয়েছে।
কলকাতা পুলিশের আবেদন।
২১ জু্ন নেতাজি ইন্ডোরে তৃণমূল কংগ্রেসের বর্ধিত কোর কমিটির বৈঠকে ছাত্রছাত্রীদের 'তোলাবাজি' থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্য়োপাধ্য়ায়। শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্য়ায় বলেছেন কোনরকম অভিযোগ থাকলে সরাসরি তাঁকে জানাতে। কলেজে ভর্তিতে দুর্নীতি কোনভাবে বরদাস্ত করা হবে না। কিন্তু তাতে কি ভর্তি নিয়ে তোলাবাজি বন্ধ হয়েছে? বিরোধী ছাত্র সংগঠনগুলির অভিযোগ, নির্দিষ্ট কিছু ছাত্র সংগঠনের মদতেই চলছে এই বেআইনি কারবার, এবং ঠুঁটো হয়ে বসে আছেন কলেজের অধ্য়ক্ষসহ বিভাগীয় প্রধানরা।
এসইউসিআই (SUCI)-এর ছাত্র সংগঠন এআইডিএসও (AIDSO)-র সহ সভাপতি চন্দন সাঁতরার বক্তব্য, "শুধু অনলাইন করে দুর্নীতি বন্ধ হবে না। সব পথ খোলা রয়েছে। কলেজের গেটে থাকতে হবে এমন নয়, এখন দূর থেকে নিয়ন্ত্রন করা যাচ্ছে। শিক্ষামন্ত্রী বলছেন সরাসরি অভিভাবকরা তাঁকে ফোন করুন। এটা কোনও সরকারি পদ্ধতি নয়।" কলেজগুলোতে বহিরাগতরা ঢুকে পড়ছে, এই অভিযোগ দীর্ঘদিনের। চন্দনের বক্তব্য়, "কিছু ক্ষেত্রে আমরা অধ্য়ক্ষকে জানিয়েছে। যেমন আশুতোষ কলেজের অধ্য়ক্ষকে জানানো হয়েছে।"
আরও পড়ুন: ঈদের ছুটিকাণ্ডে লালবাজারে হাজিরা এড়ালেন রাজস্থানের অতিরিক্ত মুখ্যসচিব
গেরুয়া শিবিরের ছাত্র সংগঠন এবিভিপি (ABVP)-র দাবি, অনলাইন ভর্তির প্রক্রিয়া সেন্ট্রালাইজ করতে হবে। এখন তা রয়েছে কলেজ-কেন্দ্রিক। অনলাইনেই ফর্ম ভরা হবে, এবং বিশ্ববিদ্য়ালয় সরাসরি অনলাইনে নাম প্রকাশ করবে। টাকা জমাও পড়বে ব্য়াংকের মাধ্য়মে। এভিবিপির সহ সভাপতি সুবীর হালদার বলেন, "কোন বিষয়ে কত টাকা দিতে হবে তা এখন সবাই জানে। বিষয়ের চাহিদা অনুযায়ী ২০,০০০, ৩০,০০০, ৫০,০০০ টাকা পর্যন্ত রেট রয়েছে। শিক্ষা এখন মাছের বাজারে পরিণত হয়েছে।"
রাজ্য় ছাত্র পরিষদ নেতা অনাবিল গুহ জানান, বর্তমান দুরবস্থার কথা শিক্ষামন্ত্রীকে বলা হয়েছে। তিনি বলেন, "সুরেন্দ্রনাথ কলেজ নিয়ে আমাদের কাছেও অভিযোগ এসেছে। তোলাবাজির প্রতিবাদে ওই কলেজের আশেপাশে আমরা বিক্ষোভ করব।"
রাজ্য় টিএমসিপি নেতা তমঘ্ন ঘোষ বলেন, "যদি কেউ অভিযোগ করতে চান অবশ্য়ই পুলিশে যেতে পারেন। শিক্ষামন্ত্রী তো বলেই দিয়েছেন তাঁকে সরাসরি বলতে পারেন।" সেন্ট্রালাইজড অনলাইন চাইছেন না কেন? তমঘ্নর জবাব, "সেটা তো প্রশাসনিক বিষয়। প্রশাসন মনে করলে চালু করবে। তবে বামফ্রন্ট সরকার তো কখনও মনেই করেনি অনলাইনে ভর্তির পদ্ধতি চালু করার কথা।"