সম্মতিপূর্বক সমকাম নিয়ে আর কোনও অবস্থান রইল না। সমকাম যৌনতা অপরাধ নয়। বৃহস্পতিবার ঐতিহাসিক এই রায় ঘোষণা করে স্পষ্ট জানাল সুপ্রিম কোর্টের ৫ বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ। প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রের নেতৃত্বে বিচারপতি রোহিংটন নরিমান, এএম খানউইলকর, ডিওয়াই চন্দ্রচূড় ও ইন্দু মালহোত্রা সহ পাঁচ সদস্যের বেঞ্চের এদিনের রায়ে বাতিল হয়ে গেল ভারতীয় সংবিধানের ব্রিটিশ আমলের ৩৭৭ ধারা। এ দিন ব্যক্তিগত অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়ে তাকে মৌলিক অধিকার হিসেবে মেনে নেয় শীর্ষ আদালত। এদিন দেওয়া রায়তে বলা হয় যে, তাতে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা নিয়ে ২০১৩ সালে সু্প্রিম কোর্টের রায় যে ‘ভুল’ ছিল, তা স্বীকার করা হয়েছে । বিচারপতি এস কে কউল এবং বিচারপতি এস এ বোবদে-ও আলাদা ভাবে যৌন স্বাধীনতার পক্ষে রায় লেখেন। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই, ৩৭৭ নিয়ে যে কিউরেটিভ পিটিশন এখনও বিচারাধীন, তাতে জয়ের আশা দেখছেন সমকামীরা।
কি বললেন বিচারপতিরা?
সি জে আই মিশ্র বলেন নিজের সত্ত্বার অস্বীকৃতি মৃত্যুকে আহ্বান করার মতোই। তিনি আরও বলেন, একজন ব্যক্তির মর্যাদা রক্ষা এবং মর্যাদার সঙ্গে বসবাস করার অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া আদালতের অবশ্য কর্তব্য। ৩৭৭ ধারার বিধানের কারণে LGBTQ সদস্যদের ওপর শোষণের বিষয়ে জোর দিয়ে বিচারপতি চন্দ্রচুড় বলেন যে, সম্প্রদায়ের অন্যান্য নাগরিকদের মতোই LGBTQ সম্প্রদায়েরও সাংবিধানিক অধিকার রয়েছে। একই সঙ্গে বিচারপতি নরিমান বলেন, সরকার এবং গণমাধ্যমকে শীর্ষ আদালতের এই রায়কে ব্যাপক প্রচার দিতে হবে, যাতে এই গোষ্ঠি কোনও বৈষম্যমূলক আচরণের সম্মুখীন না হন সে বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে।
কী এই ৩৭৭?
ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা অনুযায়ী সমকামী যৌনতাকে অপ্রাকৃতিক বলে চিহ্নিত করে তাকে শাস্তিমূলক অপরাধ বলে গণ্য করা হয়েছে, পাশাপাশি বলা হয় স্বাভাবিক নিয়মের বাইরে গিয়ে কোনও মহিলা, পুরুষ বা পশুর সঙ্গে ইচ্ছের বিরুদ্ধে যৌনকর্মে লিপ্ত হওয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ জন্য দশ বছর পর্যন্ত কারাবাস এবং জরিমানাও হওয়ার কথা উল্লেখ করা ছিল।
২০০১: দিল্লি হাইকোর্টে এনজিও নাজ ফাউন্ডেশন প্রাপ্তবয়স্কদের যৌন সমকামের স্বীকৃতি চেয়ে একটি পিটিশন জমা দেয় সর্বপ্রথম। তবে ২০০৩-এ দিল্লি হাইকোর্ট সেই আবেদন খারিজ করে দেয়। এরপর নাজ ফাউন্ডেশন ২০০৬-এ সুপ্রিম কোর্টে একই আবেদন জানায়, যা হাই কোর্ট পুনর্বিবেচনার নির্দেশ দেয়।
২০০৯: ২ জুলাই দিল্লি হাইকোর্টের একটি রায়ে জানানো হয়, সমকাম যৌনতা কোনও অপরাধ নয় প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে সম্মতিক্রমে সমকামিতার আচরণ অপরাধের আওতায় পড়ে না। এই রায়ে আরও বলা হয় যে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা ভারতীয় সংবিধানের মৌলিক অধিকার রক্ষা নীতির পরিপন্থী।
২০১৩: এই বছর ডিসেম্বরে পুনরায় সমকামিতাকে অবৈধ ঘোষণা করে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) সমকামিতাকে অপ্রাকৃতিক বলে।
৩৭৭-এর আয়তায় সমস্ত অপরাধের তথ্য সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নেয় ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (NCRB)। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরই জাতীয় NCRB ৩৭৭-র ধারার অধীন অপরাধ সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পাশাপাশি গনধর্ষণ ও হত্যার মতো অপরাধও যুক্ত করা হয় NCRB-র অপরাধ আয়তায়।
২০১৪: ২০১৪-তে নরেন্দ্র মোদীর সরকারের শপথ গ্রহণের পর, বলা হয় যে, সুপ্রিম কোর্টের বিচারের পরই ৩৭৭ ধারা সংক্রান্ত কোনও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। লোকসভায় একটি প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র রাজ্য মন্ত্রী কিরেন রিজিজু লিখিত ভাবে জানান, "না। সুপ্রিম কোর্টের কাছে ব্যাপারটিকে সাব-বিচার করা হয়। আইপিসি বিভাগ 377 সংক্রান্ত একটি সিদ্ধান্ত সুপ্রিম কোর্টের রায়ের রায় দেওয়ার পরই নেওয়া যেতে পারে।"
২০১৫: শশী থারুর প্রাইভেট মেম্বার বিল। ২০১৫ সালের লোকসভায় বিজেপির সংখ্যাগরিষ্ঠ দল এই বিলের বিরোধীতা করে।
২০১৬: ২০১৩ সালে সুপ্রিম কোর্ট সমকামী যৌনতাকে অপরাধ বলে যে রায় দিয়েছিলেন, সেই রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে কেন্দ্রর কাছে আবেদন জানান পাঁচ আবেদনকারীর দল।
২০১৭: সুপ্রিম কোর্ট ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকার বহাল রাখে।
২০১৭-র অগাস্টে এক ঐতিহাসিক রায় দেন সুপ্রিম কোর্ট। ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসাবে ঘোষণা করেন শীর্ষ আদালত। তাতে এটাও দেখানো হয় যে, "যৌনতা সংক্রান্ত যেকোনও বিষয়ই গোপনীয়তার অপরিহার্য বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে একটি।"
২০১৮: ৩৭৭ ধারার শুনানি হয় শীর্ষ আদালতে। ২০১৩ সালে সুপ্রিম কোর্ট সমকামী যৌনতাকে অপরাধ বলে রায় দিয়েছিলেন। সেই রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে কেন্দ্র যে আবেদন করেছিল, প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রের নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চ সেই রায়ের শুনানির কথা বলেন। এরপর একাধিক শুনানির পর অবশেষে রায় দিলেন শীর্ষ আদালত।
মামলার জবাবে কেন্দ্র জানায়, একই লিঙ্গের দুজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির মধ্যে যৌনসম্পর্ক বৈধ কিনা তার উপর এই ধরনের কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হবে না যে। অতিরিক্ত সলিসিটর জেনারেল (এএসজি) তুষার মেহতা সুপ্রিম কোর্টকে বলেন, "আমরা এটিকে আদালতের ওপর ছেড়ে দিয়েছি"। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক এই মামলায় সরকারের পক্ষে বক্তব্য পেশ করে একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছিলেন।