তাবলিগি জমাতের বয়স হল ৯৪। ভারতে এর শুরু হলেও এখন বিভিন্ন মহাদেশে এরা ছড়িয়ে পড়েছে। সপ্তাহখানেক আগে পর্যন্তও এদের কথা মুসলিম ছাড়া বিশেষ কেউ জানতেন না। জামাতও তাদের নিজেদের কর্মসূচি ছাড়া অন্য বিষয়ে খুব উৎসাহীও ছিল না।
এখন করোনাভাইরাস অতিমারী যখন ভারতে ছড়িয়ে পড়েছে, তখন তাবলিগি জমায়েতের দিকে বহু আঙুল এর জন্য দায়ী বলে উঠতে শুরু করেছে।
নয়া দিল্লির ৪২ বছরের এক বেসরকারি চাকুরে, নিজের নাম প্রকাশ না করবার শর্তে জানালেন, "নিজামুদ্দিন মারকাজে যা ঘটেছে তা দুর্ভাগ্যজনক এবং দায়িত্বজ্ঞানহীন। কিন্তু সোশাল মিডিয়ায় এবং এক ধরনের সংবাদ মাধ্যমে যেভাবে বিষয়টি ঘুরিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তা কুরুচিকর। তাবলিগি জামাত কোনও গোপন উপদ্রবীদের জমায়েত নয়। এদের লক্ষ্যে সেরা মুসলিম গড়ে তোলা- যারা বিশ্বাসে সনিষ্ঠ, সমাজে অবদানকারী, সতীর্থদের সাহায্যদাতা।"
তাবলিগি জামাতে কারা যোগ দিতে পারেন?
যে কেউ। কোনও আনুষ্ঠানিকতার প্রয়োজন নেই।
"এটা কোনো কমিউনিস্ট পার্টির মত ব্যাপার নয় যেখানে মেম্বারশিপ কার্ড পেয়ে কেউ লাল সেলাম বলবেন। এখানে সন্ন্যাসীদের মত পর্যায়বিভেদও নেই।" বলছিলেন গ্রেটার নয়ডা কলেজের ২২ বছরের সাকিব জায়া। তিনি বিহার থেকে এসেছেন। "জামাতের স্বেচ্ছাসেবীরা সব জায়গা থেকে আসেন। তাঁরা কোরাণ ও অন্যান্য ধর্মগ্রন্থ পাঠ করেন, আলোচনা করেন এবং সে সম্পর্কে জ্ঞান বৃদ্ধি করেন, জ্ঞান ছড়িয়ে দেন।"
তাবলিগি জামাত কী, কেমন করে চলে এ সংগঠন?
জামাতে যে কেউ যত সময়ের জন্য ইচ্ছা যোগ দিতে পারেন। কেউ শুধু বিভিন্ন অধিবেশনে যোগ দেন। কেউ একসঙ্গে তিনদিন, ১০ দিন, ৪০ দিন বা ১২০ দিন কাটাতে পারেন। তাঁদের ভ্রমণের জন্য কোনও আইডি দেখতে চাওয়া হয় না, তবে স্থানীয়রা পরস্পরকে চেনেন এবং একটা পর্যায়ে গোষ্ঠীগত ভেরিফিকেশন হয়েই যায়।
তাবলিগি জামাতে মুসলিমদের কী শেখানো হয়?
মূলত মুসলিমদের নবীর শিক্ষার আক্ষরিক ও আত্মিক অর্থ শেখানো হয়ে থাকে।
কিন্তু ধর্মীয় শিক্ষায় জোর দিতে গিয়ে মানুষকে পার্থিব কর্তব্য থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় না। ?
একমত নন নিজামউদ্দিনের ট্রাভেল এজেন্সির মালিক ওয়াসিম আমেদ সিদ্দিকি। তিনি বলছেন নবীর শিক্ষা আত্মিক যেমন, তেমনই দৈনন্দিন জীবনেও কার্যকর। যেমন ভাল মুসলিমের কাছে পেশার প্রতি যত্নবান হওয়া প্রয়োজন নাহলে আল্লার কাছে জবাবদিহি করতে হবে। স্ত্রীর কাজে সাহায্য করার বিষয়টিও যুক্ত কারণ নবী তা নিজে করেছেন এবং করতে বলেছেন। এর অর্থ কন্যাসন্তানকে সম্পত্তির অংশ দান করা। তাবলিগির স্বেচ্ছাসেবকরা এসব নিজেরা পালন করবার চেষ্টা করেন, অন্যদেরও উৎসাহ দেন।
প্রসূতি মুসলিম হওয়ায় ফেরাল হাসপাতাল, মৃত্যু নবজাতকের
নয়া দিল্লির এক নাম করা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক একটি উদাহরণ দিয়েছেন। "একবার এক দল ছাত্রের জামাতে যোগ দেবার কথা ছিল। কলেজের ছুটি পড়বার কথা ছিল মঙ্গলবার থেকে। অধিকাংশ ছাত্র ঠিক করে তারা সোমবার সবাই মিলে বাঙ্ক করবে এবং উইকেন্ড থেকেই ছুটিতে চলে যাবে। কিন্তু জামাতের লোকজন স্পষ্ট জানিয়ে দেন- ক্লাস পালিয়ে অংশগ্রহণ করা যাবে না। তারা মঙ্গলবার দিনই যেতে পারবে। জামাতের কাজের জন্য যদি কেউ নিজের কাজ বন্ধ করে, তাহলে সে ভাল মুসলমান হিসেবে গণ্য নয়। কেউ কোনও চুক্তি ভাঙতে পারবে না, কর্তব্যে অবহেলা করতে পারবে না।"
২২ বছরের ছাত্র জায়ার কথায়, কেমন করে ঠিক করে জলপান করতে হয় থেকে কী করে বয়স্কদের সঙ্গে ব্যবহার করতে হয়, সবই শেখানো হয়।
জল কীভাবে ঠিক করে পান করতে হয়! মাথা ঢেকে, ঈশ্বরের নাম নিয়ে বসে, অল্প অল্প করে জল পান করতে হবে, এক ঢোঁকে পুরোটা নয়।
জল পানের সঙ্গে মাথা ঢাকার কী সম্পর্ক?
এ ব্যাপারে ছাড় আছে। কোরাণে বলা আছে পেটে খিদে থাকলে নিষিদ্ধ খাবারও খাওয়া যেতে পারে। নিজস্ব পরিস্থিতিতে যতটা পরিমাণ সম্ভব ততটা অনুসরণ করার কথাই বলা হয়ে থাকে।
কীভাবে শিক্ষা দেওয়া হয়?
ওই অধ্যাপক ফের একটা উদাহরণ দিলেন। "ধরা যাক ১২ জন জামাতি একটা বাসে করে যাচ্ছেন। কন্ডাক্টর ১০ জনের ভাড়া কাটলেন। এবার গন্তব্যে পৌঁছে আপনি দুটো অতিরিক্ত টিকিট কেটে নিলেন। দেখতে হবে যেন পরিবহণ সংস্থা তার প্রাপ্য পায়।"
কিছু মুসলমান নিজেদের পিছিয়ে পড়া ভাবেন কেন?
সাধারণত চেতনার অভাবই এর কারণ।
এক গবেষকের কথায় দস্তারথানের ধারণা এসেছিল, যেখানে টেবিল ছিল না সেখানে যাতে মেঝেতে বসে মানুষ খেতে পারেন। দস্তরখানে উচ্ছিষ্ট খাবার কাপড় বা কাগজের উপর পড়ে, যা সহজেই তুলে ফেলা যায়, মেঝে নোংরা হয় না। কিন্তু কেউই টেবিল চেয়ার তুলে দিতে বলেনি।
তিনি বললেন, "কুর্তা-সালওয়ার পরা বা দাড়ি রাখায় উৎসাহ দেওয়া হয়। কিন্তু শিখরা কি দাড়ি রাখে না, ইহুদিরা টুপি পরে না, হিন্দু মহিলারা সিঁদুর পরেন না? কুর্তা সালওয়ার পরেও পরমাণু বিজ্ঞানী হওয়া যায়।"
নিজামউদ্দিনের সাম্প্রতিক ঘটনাবলী কী?
বেশ কিছু অভিযোগ রয়েছে। ধর্মান্তরণ তার মধ্যে একটা। জামাতিরা কাউকে ধর্মান্তরিত করে না। তারা সমবিশ্বাসীদের একত্রিত করবার চেষ্টা করে।
দ্বিতীয়ত, মারকাজে কোনও একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্যে কেউই যান না। বাংলাওয়ালি মসজিদে ১০০০ জনের বাস, এখানে মানুষজন যাতায়াত করেন।
কোভিড ১৯ সংক্রমণ খুবই হতাশাজনক। অধ্যাপকের কথায় "নিশ্চিতভাবেই বিষয়টি নজর এড়িয়ে গিয়েছে। করোনাভাইরাস সংক্রমণের কথা প্রথমবার শোনামাত্র জায়গা খালি করে দেওয়া উচিত ছিল। ওঁরা নিজেদের উদ্যোগ নিয়ে এতটাই তাড়িত ছিলেন যে চারপাশে কী ঘটছে সে দিকে নজরই রাখেননি।" তাঁর সঙ্গে সহমত হলেন বেসরকারি সংস্থার কর্মীও।
অধ্যাপক, ছাত্রী, গবেষক, সকলেই একমত সংবাদমাধ্যম উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ডাইনি শিকারের রাস্তায় নেমেছে। "ফেক ভিডিও প্রচার করা হচ্ছে। কারা লাভবান হচ্ছে এতে! জনৈক মৌলানা সাদ জনতাকে বলছেন মসজিদে মৃত্যু বেশি কাঙ্ক্ষিত। আমি যতদূর জানি এটা লকডাউনের পর প্রচারিত হয়েছে। মানুষ মৃ্ত্যুভয়ে ভীত। তাঁদের আশ্বস্ত করে বলা হয়েছে মৃত্যু আল্লাহের হাতে এবং যদি মৃত্যু আসেই তাহলে মসজিদ মৃত্যুর পক্ষে শ্রেয়।" বললেন সিদ্দিকি।
জামাতের সদস্যরা নার্সদের হেনস্থা করার ব্যাপারে কী যুক্তি আছে?
সকলেই বলছেন এটা খুব অস্বাভাবিক এবং তাবলিগি জামাতের ভাবধারার সম্পূর্ণ বিপরীত। যদি অভিযোগ প্রমাণিত হয় তাহলে তাঁকে শাস্তি পেতে হবে এবং আল্লাহের কাছে জবাবদিহি করতে হবে।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন