Advertisment

'এত মারো যেন মরে যায়', তবরেজ আনসারি মৃত্যু মামলায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে উঠল প্রশ্ন

ঝাড়খণ্ড পুলিশের মতে এটি "পূর্বপরিকল্পিত খুনের মামলা নয়", এবং ২২ বছরের তবরেজের মৃত্যু হয়েছে হার্ট অ্যাটাকে, মাথায় আঘাত পেয়ে নয়।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
tabrez ansari lynching

ভিডিও থেকে নেওয়া স্ক্রিনশট

তবরেজ আনসারির মৃত্যুর মামলায় ইন্ডিয়ান পিনাল কোড (আইপিসি) অর্থাৎ ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০২ ধারা (খুন) বাতিল করেছে ঝাড়খণ্ড পুলিশ, যেহেতু তাদের মতে এটি "পূর্বপরিকল্পিত খুনের মামলা নয়", এবং ২২ বছরের তবরেজের মৃত্যু হয়েছে হার্ট অ্যাটাকে, মাথায় আঘাত পেয়ে নয়।

Advertisment

কিন্তু চার্জশিট, কেস ডায়েরি, এবং প্রামাণিক সাক্ষ্যের বিশ্লেষণ করলে এই সিদ্ধান্ত নিয়ে উঠে আসছে প্রশ্ন। তবরেজের আত্মীয় মহম্মদ মসরুর আলম, যিনি তবরেজের আক্রান্ত হওয়ার খবর শুনেই ঘটনাস্থলে ছুটে যান, এই মর্মে বয়ান দিয়েছেন যে তিনি ভিড়ের মধ্যে কাউকে বলতে শোনেন, "ইতনা মারো কি মর যায় (এত মারো যেন মরে যায়)।"

আরও পড়ুন: ঝাড়খণ্ড গণপ্রহার কাণ্ডে ‘ব্যথিত’ মোদী

প্রধান জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে ২৩ জুলাই পেশ করা চার্জশিটে যে ২৪ জন সাক্ষীর বয়ান ছিল, তাঁদের মধ্যে তবরেজও ছিলেন। চার্জশিটে ময়নাতদন্তকারী মেডিক্যাল বোর্ডের একটি প্রথমিক রিপোর্টেরও উল্লেখ রয়েছে, যাতে বলা হয়েছে যে যদি ভিসেরা (অভ্যন্তরীণ অঙ্গ) রিপোর্টে দেখা যায় যে "বিষক্রিয়ায়" মৃত্যু হয় নি, তবে মাথার আঘাতই মৃত্যুর কারণ।

কিন্তু কেস ডায়েরি বলছে, ভিসেরা ফরেনসিক ল্যাবরেটরিতে পাঠানোর সময়ই পুলিশ অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০৪ ধারা (শাস্তিযোগ্য নরহত্যা যা খুন নয়) লাগু করে। যার অর্থ হলো, চার্জশিট থেকে ৩০২ ধারা বাতিল করার সময় ভিসেরা রিপোর্টকে আমল দেওয়া হয় নি। কেস ডায়েরির একটি তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য হলো: "ভিসেরা রিপোর্টের পর আইপিসি ধারা বদলাতেও পারে।"

গত ১৮ জুন ঝাড়খণ্ডের সেরাইকেলা-খারসাওয়ান জেলার ধাতকিডি গ্রামে চুরির দায়ে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে গণপ্রহার করা হয় তবরেজকে। ঘটনার একটি ভিডিওতে দেখা যায়, মারধর চলাকালীন "জয় শ্রীরাম" এবং "জয় হনুমান" বলতে বাধ্য করা হচ্ছে তবরেজকে। চুরির অভিযোগে পুলিশি হেফাজতে নেওয়া হয় তাঁকে। চারদিন পর এক স্থানীয় হাসপাতালে মৃত্যু হয় তাঁর।

আরও পড়ুন: তবরেজ আনসারি হত্যার দায়ে অভিযুক্ত কারা?

মঙ্গলবার ৩০২ ধারা বাতিল প্রসঙ্গে সেরাইকেলা-খারসাওয়ান জেলার পুলিশ সুপার কার্তিক এস ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে জানান, "আমরা আইপিসি ৩০৪ ধারার আওতায় মামলা দায়ের করি দুটি কারণে। এক, ঘটনাস্থলে মৃত্যু হয় নি...আনসারিকে মারার উদ্দেশ্য গ্রামবাসীদের ছিল না। দুই, মেডিক্যাল রিপোর্ট খুনের অভিযোগ সমর্থন করছে না। চূড়ান্ত পোস্ট-মর্টেম রিপোর্টে বলা হয়েছে আনসারির মৃত্যু হয় হার্ট অ্যাটাকে, এবং মাথায় রক্তক্ষরণ প্রাণঘাতী ছিল না। দ্বিতীয় মেডিক্যাল মতামত অনুযায়ী, মৃত্যুর কারণ যৌথভাবে হার্ট অ্যাটাক এবং মাথায় আঘাত।"

কেস ডায়েরির কিছু গুরুত্বপূর্ণ অংশ:

* ডাক্তারদের যে বোর্ড পোস্ট-মর্টেম করে, সেই বোর্ডের তৈরি আঘাতের তালিকায় বাহ্যিক আঘাতের মধ্যে ছিল মাথার জখম, এবং অভ্যন্তরীণ আঘাতের মধ্যে ছিল ব্রেনে জমাট বাঁধা রক্ত এবং রক্তে ভরাট হয়ে যাওয়া হৃদযন্ত্রের চেম্বার। কিন্তু ফরেনসিক পরীক্ষা না হওয়া পর্যন্ত তাঁদের মতামত দেন নি চিকিৎসকরা। পুলিশকে তাঁরা বলেছিলেন, "এই আঘাতগুলিতেই মৃত্যু হয়েছে এমন বলা যায় না, কিন্তু হয়েও থাকতে পারে। আঘাত অত্যন্ত গুরুতর।" বোর্ডের কাছ থেকে যখন নিশ্চিতভাবে জানতে চাওয়া হয় যে ভিসেরা রিপোর্টে বিষক্রিয়ার প্রমাণ না থেকে থাকলে মৃত্যুর কারণ কী হবে, উত্তর হয়: "মৃত্যুর কারণ হবে মাথার আঘাত।"

* তাঁর বয়ানে তবরেজের আত্মীয় আলম বলেন, ১৮ জুন সকালে স্ত্রীকে ফোন করেন তবরেজ। "ও বলে যে ওকে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে মারা হচ্ছে। ওকে যেন এসে বাঁচানো হয়," বলেছেন আলম। এরপর সকাল সাড়ে ছটা নাগাদ আলম এবং তাঁর ছোট ভাই গ্রামে ছুটে যান, এবং গিয়ে দেখেন যে কোমরে দড়ি বাঁধা অবস্থায় খুঁটির সঙ্গে বেঁধে মারা হচ্ছে তবরেজকে। পুলিশকে আলম জানান, "অত লোকের ভিড় দেখে আমরা ভয়ে পেয়ে যাই; অনেকেই চিৎকার করছিল, আমরা ওর থেকে ২০-২৫ ফুট দূরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। একজন চেঁচাচ্ছিল, "ইতনা মারো কি মর যায়।"

আরও পড়ুন: ঝাড়খণ্ডের ‘খুন’ মানবতার কলঙ্ক: সৌগত রায়

আলমের বয়ানে আরও বলা আছে, থানায় নিয়ে আসা হলে প্রায় নড়তেই পারছিলেন না তবরেজ, এবং "অজ্ঞান" অবস্থাতেই ছিলেন। পুলিশের কাছে আলমের বক্তব্য, পরের দিন তিনি যখন জেলে তবরেজের সঙ্গে দেখা করেন, তাঁকে কাঁদতে দেখেন তিনি। "ও আমাদের বলেছিল ওর মাথায় খুব লেগেছে এবং আমরা যেন চিকিৎসার ব্যবস্থা করাই," বলেছেন আলম।

* যিনি ঘটনার ভিডিও তোলেন, সেই টিঙ্কু মণ্ডল পুলিশের কাছে ভিডিওটির সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। তবে তিনি যে ভয়ের চোটে সমস্ত ভিডিও ক্লিপ ডিলিট করে দেন, সেকথাও জানিয়েছেন। "১৮ জুন ভোরে আমি অনেক লোকের চিৎকার শুনতে পাই। দেখলাম একজনকে ইলেকট্রিক খুঁটির সঙ্গে বেঁধে তাকে গালিগালাজ করছে অনেকে। লাঠি দিয়ে মারাও হচ্ছিল তাকে, যদিও অনেকে আবার মার আটকানোর চেষ্টা করছিলেন। আনসারি কাউকে ফোন করছিল। গ্রামের লোক ওকে বলে ওর দুই বন্ধুকে ফোন করতে (অভিযোগ, ওই দুজনের সঙ্গে মিলে চুরি করতে যান তবরেজ, এবং পালিয়ে যান তাঁরা)," পুলিশকে জানান মণ্ডল। তাঁর বয়ানে একথাও বলা হয়েছে যে তবরেজকে "জয় শ্রীরাম" এবং "জয় হনুমান" বলতে বাধ্য করা হয়।

'সারারাত লাঠি দিয়ে মারা হয়'

অন্যদিকে, চার্জশিটে বলা হয়েছে যে পুলিশের কাছে যা খবর ছিল, তাতে চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েন তবরেজ। লেখা হয়েছে, "ক্রুদ্ধ গ্রামবাসীরা তাঁকে বেঁধে সারারাত, এবং সকালেও, লাঠি দিয়ে মারতে থাকে। তাঁর ধর্মীয় বিশ্বাসের বিরুদ্ধে তাঁকে জয় শ্রীরাম এবং জয় হনুমান বলতে বাধ্য করা হয়।"

তবরেজের স্ত্রী শাহিস্তা পরভিনের উকিল আলতাফ হুসেন জানিয়েছেন, খুনের দায় বাতিল হওয়ার বিরুদ্ধে আদালতে একটি "প্রতিবাদ পিটিশন" দায়ের করেছেন তিনি।

Advertisment