Advertisment

২৪ ঘন্টায় পেরিয়েছেন ৬০০ কিমি, 'শত্রুর সঙ্গেও যেন না হয়', দুঃসহ স্মৃতিতে কাঁটা মুম্বইবাসী পড়ুয়া

দেশে ফিরলেও কিয়েভ থেকে পালানোর দুঃসহ স্মৃতি মুম্বইয়ের ডাক্তারি পড়ুয়ার পিছু ছাড়ছে না

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Thane students 600 km journey from Kyiv to Romanian border

যশ পাল

দেশে ফিরলেও কিয়েভ থেকে পালানোর দুঃসহ স্মৃতি মুম্বইয়ের ডাক্তারি পড়ুয়ার পিছু ছাড়ছে না। হাঁটতে হয়েছে মাইলের পর মাইল, ২৪ ঘণ্টায় পেরোতে হয়েছে ৬০০ কিলোমিটার পথ।

Advertisment

'দূরত্বটা ৬০০ কিলোমিটার।' স্বগতোক্তির ঢঙেই যেন বলে যাচ্ছিলেন যশ পাল। ইউক্রেনের এই ডাক্তারি পড়ুয়া সেই সৌভাগ্যবানদের একজন, যাঁরা ইতিমধ্যেই দেশে ফিরতে পেরেছেন। সব মিলিয়ে পাঁচ দিন সময় লেগেছে, ইউক্রেন থেকে ফিরতে। থুড়ি, ফিরতে নয়, পালাতে! রোমানিয়ার বুখারেস্ট থেকে তাঁকে নিয়ে মুম্বইয়ে ফিরেছে বিশেষ বিমান।

বেঁচে গিয়েছেন, দেশে ফিরেছেন। এতে খুশিই হওয়ার কথা। কিন্তু, যশ পাল হতে পারছেন না। তাঁকে তাড়া করে ফিরছে কিয়েভ থেকে রোমানিয়া, এই ৬০০ কিলোমিটার পেরনোর দুঃসহ স্মৃতি। আর, যতবার এই স্মৃতি নাড়া দিচ্ছে, যশ পালের মুখ থেকেও স্বগতোক্তিটা বেরিয়ে আসছে। তাঁর কথায়, 'গত পাঁচ দিন পুরো নরকযন্ত্রণা ভোগ করেছি। বিস্ফোরণের শব্দ শুনেছি। গুলির শব্দ শুনেছি। দেখেছি মানুষ রক্তাক্ত অবস্থাতেও দৌড়চ্ছে। এমন যন্ত্রণা যেন শত্রুকেও ভোগ করতে না-হয়।'

পশ্চিম ইউক্রেনের ইভানো-ফ্র্যাঙ্কিভক্স ন্যাশনাল মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটির পড়ুয়া যশ পাল। যুদ্ধের আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য পড়ুয়াদের মতোই ছিলেন ইভানো ফ্র্যাঙ্কিভস্ক শহরেই। ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে কিয়েভ থেকে বিমান ধরতে রওনা দিয়েছিলেন। কিন্তু, রাশিয়া বিমানবন্দরে বোমা ফেলা শুরু করে। যশ পাল এবং অন্যদের কিয়েভ বিমানবন্দর ছাড়ার পরামর্শ দেয় ইউক্রেন সরকার।

সাইরেন বাজছে। পরপর বোমা পড়ছে। তার মধ্যেই কিয়েভ বিমানবন্দর থেকে কিয়েভে ভারতীয় দূতাবাসের দিকে হাঁটা শুরু করেন যশ। পথ চেনেন না। ভরসা বলতে ছিল মোবাইলের রুট ম্যাপ। শেষ পর্যন্ত দূতাবাসে পৌঁছতে পারবেন কি না, তা-ও বুঝতে পারছিলেন না। শেষ পর্যন্ত অবশ্য কিয়েভের ভারতীয় দূতাবাসে পৌঁছন। দূতাবাসের আধিকারিকদের পরামর্শেই এলাকার এক পরিত্যক্ত স্কুলবাড়িতে আশ্রয় নেন। স্কুল থেকে দূতাবাস কর্মীদের পরামর্শেই বেরোননি। ভিতর থেকেই পেয়েছেন গোলা-গুলির আওয়াজ।

এই ভাবেই তিন দিন কেটে যায়। তৃতীয় দিন বোমার আওয়াজটা ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট। স্কুলবাড়ির আশ্রিতরা বুঝে যান, কাছেই কোথাও বোমা পড়েছে। ভয়ে তাঁরা আর সেদিন দু'চোখের পাতা এক করতে পারেননি। তার মধ্যে খাবার কমে আসছিল। স্থানীয় প্রশাসন তখনও তাঁদের দু'বেলা করে খাবার দিচ্ছিল। যশদের নিজেদেরকেই খাবার পরিবেশন করতে হয়েছে সেই সময়।

প্রায় সদ্য তৈরি হওয়া স্মৃতির পাতা খুলে বলে যাচ্ছিলেন ইউক্রেনের ওই ডাক্তারি পড়ুয়া। বলছিলেন, খাবারের মধ্যে থাকত দুটো ফল, একটু ভাত আর সিদ্ধ সবজি। কিন্তু, পানীয় জল এতই কম দেওয়া হত যে খাবার হজম করাই কঠিন হয়ে পড়ত। পাল জানান, তৃতীয় দিন মানে ২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ঠান্ডা, মানসিক চাপ আর খিদের জ্বালায় তাঁর হাত-পা কাঁপা শুরু হয়ে যায়।

সেই প্রথম তিনি দেখেন, তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও তিন পড়ুয়া ওই স্কুলবাড়িতেই আশ্রয় পেয়েছেন। সব মিলিয়ে ওই স্কুলবাড়িতে আশ্রিতের সংখ্যা বেড়ে হয় ৪০০। এসব দেখে প্রতিপদে মৃত্যুর আশঙ্কার মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাকি দুই পড়ুয়াকে নিয়ে যশ কিয়েভ রেল স্টেশনে পৌঁছন। কিন্তু, ভিড়ের জন্য ট্রেনে উঠতে পারেননি। ১২ ঘণ্টা স্টেশনে অপেক্ষার পর ট্রেনে ওঠার সুযোগ পান। রাত তিনটেয় পৌঁছন ইভানো ফ্র্যাঙ্কিভস্কে। কার্ফু থাকায় স্টেশনের ঠান্ডা মার্বেলেই রাত কাটান। গায়ে পাঁচটা পোশাক চড়িয়েছিলেন। কিন্তু, তারপরও যেন শীত মরছিল না। দু'চোখের পাতা এক করতে পারেননি যশ।

সকাল ৮টার সময় স্টেশনের সামনে একটি গাড়ি প্রায় জোর করেই থামান। সেই গাড়ি তাঁদের রোমানিয়া সীমান্তের কাছে ছেড়ে দেয়। কারণ, সীমান্তে তখন বিরাট জ্যাম। চরম ঠান্ডায় তার মধ্যেই ভারী মালপত্র নিয়ে ৯ কিলোমিটার হেঁটে সীমান্তে পৌঁছন যশ ও তাঁর সঙ্গীরা। শরীর ভেঙে পড়ছে, ততক্ষণে খাবার থেকে গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্র আছে, এমন একটা ব্যাগও কোথায় যেন হারিয়ে ফেলেছেন। ২০ ঘণ্টা সীমান্তে ভিড়ভাট্টার মধ্যে অপেক্ষার পর যশ বুঝতে পারেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই সঙ্গীর থেকেও তিনি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন।

সীমান্তে তখন কাতারে কাতারে মানুষ। আর, ভিড় সামলাতে ইউক্রেনের সেনারা তাঁদের দিকে জলকামান ব্যবহার করছেন। মাইনাস ৫ থেকে সাত ডিগ্রি সেলসিয়াস ঠান্ডার মধ্যে জল ছিটানো হচ্ছিল। শুধু জল ছিটানোই না। ৫ থেকে ৭ রাউন্ড গুলিও ছোড়েন ইউক্রেনের সীমান্তরক্ষীরা। পালাতে গিয়ে হুড়োহুড়িতে বহু লোক পায়ে চাপা পড়েন। তবে, সীমান্ত পেরনোর পর আর তাঁকে তেমন ভুগতে হয়নি। সীমান্ত থেকে প্রথমে ত্রাণশিবিরে। সেখান থেকে বুখারেস্ট। আর, সেখান থেকে বিমানে মুম্বই। কিন্তু, সেসব ছাপিয়ে তার আগের দুর্ভোগটাই এখনও ভিড় করে আছে যশ পালের স্মৃতিতে।

Read in English

Indian Embassy in Kyiv Ukraine Crisis Russia-Ukraine Conflict Indian citizens left Kyiv
Advertisment