মার্কিন কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে বক্তব্য রাখার সময় মোদী বলেন, “আজকের পরিবর্তিত ভারত তামাম বিশ্বকে তাক লাগাতে বাধ্য”। পাশাপাশি মোদী এআই থেকে ইউক্রেন সংকট নিয়েও তার বক্তব্য পেশ করেন।
‘আজকের পরিবর্তিত ভারত আপনাকে অবাক করবে’ মার্কিন কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে শক্তিশালী এক ভাষণে দেশের সামগ্রিক উন্নয়নকে তুলে ধরেছেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। মার্কিন সফর শেষে মিশরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী শুক্রবার সকালে (ভারতীয় সময়) ওয়াশিংটনের রোনাল্ড রিগান সেন্টারে প্রবাসী ভারতীয়দের একটি বিশাল সমাবেশে ভাষণ দেন, এর মধ্য দিয়ে তিনি তার তিন দিনের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় সফর শেষ করেছেন। ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেন, "আজকের পরিবর্তিত ভারত আপনাকে অবাক করবে, তিনি যোগ করেন আজ দেশ এক অভূতপূর্ব ডিজিটাল বিপ্লব প্রত্যক্ষ করেছে।"
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী শুক্রবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় প্রবাসীদের ভূমিকার প্রশংসা করেছেন এবং রোনাল্ড রিগান সেন্টারে তার ভাষণে ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে অংশীদারিত্ব জোরদার করার জন্য তাদের কৃতিত্বকে তুলে ধরেন। বিপুল সংখ্যক মানুষের উপস্থিতির জন্য অনাবাসী ভারতীয় সম্প্রদায়কে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদী বলেন, "আপনাদের সকলের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে সভামঞ্চে আমি ভারতের সম্পূর্ণ মানচিত্র প্রত্যক্ষ করছি। আমি এখানে ভারতের প্রতিটি প্রান্ত থেকে মানুষকে দেখতে পাচ্ছি। মনে হচ্ছে এটা এক ‘মিনি ইন্ডিয়া’"।
মোদী এদিন তাঁর ভাষণে বলেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে বক্তব্য রাখা সবসময়ই গর্বের এক বিষয়। দু’বার এই সুযোগ পাওয়া অত্যন্ত ব্যতিক্রমী। এই সম্মান দেওয়ার জন্য আমি ১৪০ কোটি ভারতবাসীর পক্ষ থেকে আমার কৃতজ্ঞতা জানাই। ২০১৬ সালে আমি যখন এখানে এসেছিলাম তখন যাঁদের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল বর্তমানে তাঁরা অনেকেই এখানে রয়েছেন। ফলে, পুরনো বন্ধুদের ভালোবাসার অনুভূতি আমার হচ্ছে। নতুন যাঁরা এসেছেন তাঁদের উৎসাহ-উদ্দীপনা আমার নজরে আসছে। ২০১৬ সালে সেনেটর হ্যারি রিড, সেনেটর জন ম্যাকিন, সেনেটর ওরিন হ্যাচ, এলিজা কামিংস, অ্যালসি হেস্টিংস সহ অনেকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলাম। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাঁরা আর আমাদের মধ্যে নেই’। তিনি বলেন, ‘মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ, মানুষের কথা শোনা এবং তাঁদের অনুভূতিকে উপলব্ধি করাই হল গণতন্ত্রের প্রকৃত সৌন্দর্য। এর জন্য অনেক সময়, পরিশ্রম ও উদ্যোগ ব্যয় করতে হয়, অনেকটা পথ হাঁটতে হয়। আজ আপনাদের কারোর কারোর দূরে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল, কিন্তু এর মধ্যেও আপনারা আমাকে সময় দিয়েছেন। এর জন্য আমি আপনাদের কাছে কৃতিজ্ঞ”।
মোদী তাঁর ভাষণে বলেন, ‘গত বছর ভারত তার স্বাধীনতার ৭৫তম বর্ষ উদযাপন করেছে। প্রতিটি মাইলফলকই গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু এটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। হাজার হাজার বছর নানাভাবে বিদেশি শাসনে থাকার পর আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। তারপর ৭৫ বছরের এক গুরুত্বপূর্ণ সফর করেছি। এটি শুধুমাত্র গণতন্ত্রকে উদযাপন করাই নয়, এই উদযাপন বৈচিত্র্যেরও। আমরা যেমন সংবিধান পেয়েছি, একইসঙ্গে সামাজিক ক্ষমতায়নেরও ভাবনায় বিকশিত হয়েছি। আমাদের প্রতিযোগিতামূলক এবং সহযোগিতামূলক এক যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো যেমন রয়েছে, পাশাপাশি আমাদের ঐক্য ও সংহতিও রয়েছে”। তিনি আর ও বলেন, “আজ সারা বিশ্ব ভারত সম্পর্কে আরও বেশি করে জানতে চায়। এই অনুষ্ঠান মঞ্চেও আমি সেই কৌতুহল প্রত্যক্ষ করেছি। গত এক দশকে আমরা ভারতে কয়েকশো মার্কিন কংগ্রেসের সদস্যদের অভ্যর্থনা জানিয়েছি। তাঁরা সকলেই ভারতের উন্নয়ন, গণতন্ত্র এবং বৈচিত্র্য সম্পর্কে বুঝতে চান। এই মুহূর্তে ভারত কি করছে তা জানতে চান। আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের কাছে সেই প্রসঙ্গটি আমি জানিয়েছি” ।
ভারতের ডিজিট্যাল বিল্পব প্রসঙ্গে মোদী বলেন, “গত ৯ বছর ধরে ১০০ কোটির বেশি মানুষের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ও মোবাইল নম্বরের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করার ফলে অনন্য এক ডিজিটাল বায়োমেট্রিক পদ্ধতির সূচনা হয়েছে। এই পরিকাঠামো গড়ে ওঠায় মুহূর্তের মধ্যে আমাদের নাগরিকরা প্রত্যক্ষ সুবিধা হস্তান্তর প্রকল্পে আর্থিক সহায়তা পেয়ে থাকেন। ৮৫ কোটি মানুষ তাঁদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে নানা ধরনের আর্থিক সুবিধা পেয়েছেন। কোটি কোটি কৃষকের অ্যাকাউন্টে বছরে তিনবার শুধুমাত্র একটি বোতাম টিপে টাকা পাঠানো হচ্ছে। এই ধরনের আর্থিক লেনদেনের পরিমাণ ৩২ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। কিন্তু এই পদ্ধতিতে আমরা ২,৫০০ কোটি ডলার সাশ্রয় করেছি। আপনারা যদি ভারত সফর করেন তাহলে দেখবেন, সেখানে প্রত্যেকেই ফোনের মাধ্যমে আর্থিক লেনদেন চালাচ্ছেন। রাস্তার হকাররাও এখন এভাবেই টাকা-পয়সার লেনদেন করেন।
তিনি আরও জানিয়েছেন, “গত বছর সারা বিশ্বে প্রতি ১০০টি ডিজিটাল আর্থিক লেনদেনের মধ্যে ৪৬টিই ভারতে হয়েছে। প্রায় ৪ লক্ষ মাইল অপটিক্যাল ফাইবার বসানো হয়েছে, সস্তায় ডেটা পরিষেবা দেওয়ার ফলে বহু মানুষ উপকৃত। কৃষকরা সহজেই আবহাওয়া সম্পর্কে তথ্য পাচ্ছেন। প্রবীণ নাগরিকরা তাঁদের সামাজিক সুরক্ষা খাতে প্রয়োজনীয় সহায়তা এর মাধ্যমে পেয়ে থাকেন। ছাত্রছাত্রীরা বিভিন্ন বৃত্তির সুযোগ পাচ্ছেন। চিকিৎসকরা প্রযুক্তি ব্যবহার করে টেলি-মেডিসিনের সুবিধা মানুষের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন। মৎস্যজীবীরা কোথায় মাছ পাওয়া যাবে, কিংবা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা কিভাবে ঋণ পাবেন তাও তাঁদের ফোনের সাহায্যেই জানতে পারছেন। গণতন্ত্রের ভাবনা, সমন্বয় এবং স্থিতিশীলতা আজ সর্বত্র অনুভূত। এর মধ্য দিয়ে সারা পৃথিবীর কাছে আমাদের পরিচিতিও নতুনভাবে আত্মপ্রকাশ করেছে। আমাদের এই গ্রহের প্রতি কর্তব্য ভারতে ক্রমশ বাড়ছে”।
জি-২০ সভাপতিত্ব প্রসঙ্গে মোদী তাঁর ভাষণে বলেন, “আমরা ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ ভাবনায় বিশ্বাসী অর্থাৎ, ‘এক বিশ্ব এক পরিবার’। বিশ্বের প্রতিটি মানুষ যাতে উপকৃত হন সেভাবেই আমরা আমাদের কাজ করি। বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে পরিবেশ-বান্ধব জ্বালানি পৌঁছে দিতে ‘এক সূর্য, এক পৃথিবী, এক গ্রিড’ ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ‘এক বিশ্ব, এক স্বাস্থ্য’ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এই পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণী উন্নতমানের স্বাস্থ্য পরিষেবা পাবেন, এই ভাবনায় আমরা বিশ্বাসী।
একইভাবে যখন আমরা জি-২০ গোষ্ঠীর সভাপতিত্বের দায়িত্ব পালন করছি তখন ‘এক বিশ্ব, এক পরিবার, এক ভবিষ্যৎ’ ভাবনায় এগিয়ে চলেছি। আমরা যোগাভ্যাসের মাধ্যমে সারা পৃথিবীর মধ্যে ঐক্যভাব গড়ে তুলতে চাই। গতকালই সারা পৃথিবী জুড়ে আন্তর্জাতিক যোগ দিবস উদযাপিত হয়েছে। মাত্র এক সপ্তাহ আগে শান্তিরক্ষী বাহিনীর শহীদ সদস্যদের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য রাষ্ট্রসঙ্ঘে স্মারক প্রাচীর গড়ে তোলার যে প্রস্তাব আমরা দিয়েছিলাম, সব দেশ তাকে স্বাগত জানিয়েছে।
এ বছর সারা বিশ্ব আন্তর্জাতিক মিলেট বর্ষ পালন করছে। এর মধ্য দিয়ে সুস্থায়ী কৃষি ও পুষ্টির দিকটিকে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে। কোভিডের সময় আমরা ১৫০টির বেশি দেশে ওষুধ ও টিকা সরবরাহ করেছি। বিপর্যয়ের সম্মুখীন নানা দেশে প্রথম আমরাই ত্রাণ ও উদ্ধার কাজে দল পাঠিয়ে থাকি। যাঁদের প্রয়োজন বেশি তাঁদেরই আমরা আমাদের সীমিত সম্পদের মাধ্যমে সহায়তা করেছি। আমরা পরনির্ভরতা নয়, দক্ষতা গড়ে তুলতে উদ্যোগী”।
প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ এল-সিসির আমন্ত্রণে মোদী মার্কিন সফর শেষে দু-দিনের মিশর সফরে যাচ্ছেন। ১৯৯৭ সালের পর এই প্রথমবার কোনও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মিশর সফরে যাচ্ছেন। স্বাভাবিকভাবেই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের দিক থেকে নরেন্দ্র মোদীর এই সফর যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বলেই মনে করছেন ওয়াকিবহলমহল।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় সম্প্রদায়ের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী মোদীর ভাষণ থেকে এখানে শীর্ষ কিছু বিষয়ঃ
- "প্রতিরক্ষা চুক্তি ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে অংশীদারিত্বকে শক্তিশালী করবে।আজ ভারতের অগ্রগতির সবচেয়ে বড় কারণ হল ১৪০ কোটি ভারতীয়দের আত্মবিশ্বাস।" প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে ভারতীয় সম্প্রদায়ের উদ্দেশ্যে বলেন।
- বছরের পর বছর ধরে ভারতের উন্নয়নের প্রশংসা করে প্রধানমন্ত্রী মোদী বলেন, "আজকের নতুন ভারত নিজের সম্পর্কে আত্মবিশ্বাসী, এটি সম্ভাবনাকে কর্মক্ষমতায় পরিবর্তন করছে। গত কয়েক বছরে ভারত যে ডিজিটাল রূপান্তর করেছে তা আপনাকে অবাক করবে।"
- "গত কয়েক বছরে ভারত যেভাবে ডিজিটাল বিপ্লব দেখেছে তা নজিরবিহীন। হয়তো আপনি আপনার গ্রামের একটি দোকানে একটি কিউ আর কোড দেখতে পাবেন। হয়তো আপনি নগদ অর্থ প্রদান করার চেষ্টা করেন এবং দোকানদার জিজ্ঞাসা করেন আপনার কাছে ইউ পি আই পেমেন্ট মোড আছে কিনা? এই রূপান্তরিত ভারত আপনাকে বিস্মিত করবে। আজ যে কেউ, ভারতের যে কোনও জায়গায় 24x7 ব্যাঙ্কিং-এর সুবিধা নিতে পারেন”।
- বড় বড় প্রযুক্তি সংস্থাগুলিকে ভারতে বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদী বলেন, "ভারতে যতটা সম্ভব বিনিয়োগ করার এটাই সেরা সময়। ভারতে গুগলের এআই গবেষণা কেন্দ্র ১০০টিরও বেশি ভাষায় কাজ করবে। ভারত সরকার, হিউস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে এখানে তামিল স্টাডিজ চেয়ার স্থাপন করা হবে।"
- প্রায় ৪০ মিনিটের দীর্ঘ ভাষণে, প্রধানমন্ত্রী মোদী বলেন, "আমেরিকার অগ্রগতিতে প্রবাসী ভারতীয়রা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তরুণ উদ্যোক্তাদের উত্সাহিত করার পাশাপাশি এবং ভারতের এই উন্নয়নে তাদের অবদান রাখার জন্য অনুরোধ করছি।"
- মোদী বলেন, "আমি খুশি যে আমেরিকান সরকার আমাদের কাছ থেকে চুরি যাওয়া ১০০ টিরও বেশি পুরাকীর্তি ফেরত দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই প্রত্নসামগ্রীগুলি ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য, আমাদের অনুভূতিকে সম্মান করার জন্য আমি আমেরিকান সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই,"।
- "ভারত গণতন্ত্রের জননী, বিশ্ব আজ দুটি মহান গণতন্ত্রের সম্পর্ককে শক্তিশালী করার দিকে নজর রাখছে," ।