মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাহাড় সফরের আগেই জলপাইগুড়ি জেলার গজোলডোবায় মেগা ট্যুরিজম হাবের প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ করতে চাইছে রাজ্য পর্যটন দপ্তর। তাই মুখ্যমন্ত্রীর সাধের 'ভোরের আলো' সাজিয়ে তুলতে তোড়জোড় শুরু হয়েছে কর্মীদের মধ্যে। মুখ্যমন্ত্রীর রোষানল থেকে বাঁচতে প্রথম দফায় তড়িঘড়ি ৬টি কটেজের কাজ শেষ করতে চাইছে পর্যটন দপ্তর। ইতিমধ্যেই কটেজের কাজ প্রায় শেষ বলে সংশ্লিষ্ট দপ্তর সূত্রে খবর। নবান্ন সূত্রে খবর, সোমবার পাহাড় সফরে শিলিগুড়ি আসছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়। মঙ্গলবার দার্জিলিং পাহাড় নিয়ে জিটিএ বোর্ডের সদস্যদের সাথে একটি বৈঠক করার কথা রয়েছে তাঁর। বৈঠক শেষে বুধবার সন্ধ্যায় শিলিগুড়ি ফিরে উত্তরকন্যায় রাত্রিবাস করার কথা রয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর। সেই সময়ে 'ভোরের আলো' নিয়ে প্রশ্ন করতে পারেন তিনি। এমনকি সেখানে যাওয়ার ইচ্ছাও প্রকাশ করতে পারেন মুখ্যমন্ত্রী। এমতাবস্থায় কাজ শেষ না হলে সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে যে মুখ্যমন্ত্রীর ক্ষোভের মুখে পড়তে হতে পারে তা দপ্তরের আধিকারিকদের ভালোভাবেই জানা আছে। তাই তড়িঘড়ি ভোরের আলোর প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ করতে চাইছে রাজ্য পর্যটন দপ্তর।
প্রায় ২,২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে গজলডোবায় মেগা ট্যুরিজম হাব তৈরির কাজ শুরু করেছে রাজ্য পর্যটন দপ্তর। মুখ্যমন্ত্রী এই ট্যুরিজম হাবের নাম দিয়েছেন 'ভোরের আলো'। উত্তরবঙ্গের পর্যটনকে এক অন্য মাত্রা দিতেই এই উদ্যোগ তাঁর।
বছর দুয়েক আগে গাজলডোবায় পর্যটন দপ্তরের মাধ্যমে ভোরের আলোর কাজ শুরু করে রাজ্য সরকার। কাজ শুরু হতেই উত্তরবঙ্গের শিল্পপতিরাও এই প্রকল্পে সহযোগিতার হাত বাড়ান। প্রকল্পে মোট ৩০টি কটেজ, ফরেস্ট সাফারি, বোটিং,সাইকেলিং, অর্কিড পার্ক, হাতি সাফারি, ইকো পার্ক সহ একাধিক চমক থাকছে। এছাড়াও মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ মতো তৈরি হচ্ছে একটি মহল। যার নাম দেওয়া হয়েছে হাওয়া মহল।
রাজ্য সরকারের মোট ১২ টি দপ্তর এবং পর্যটন দপ্তর এই প্রকল্প বাস্তবায়িত করার কাজ শুরু করেছে। কিন্তু পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার অভিযোগ তুলে এই প্রকল্পকে চ্যালেঞ্জ করে এক পরিবেশপ্রেমী ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইব্যুনালে একটি মামলা করেন। সেই মামলার দরুন প্রকল্পের কাজ কিছুদিনের জন্য থমকে যায়। কাজ বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয় গ্রিন ট্রাইব্যুনাল। রাজ্যের কাছে বেশ কিছু বিষয় জানতে চায় পরিবেশ আদালত। দ্রুত পরিবেশ আদালতে নিজেদের হলফনামা পেশ করে সমস্যা মিটিয়ে ফের প্রকল্পের কাজ শুরু করে রাজ্য সরকার। কিন্তু এরপর থেকেই হঠাৎ করে কাজের গতিতে বাধা পড়ে যায়। প্রায় বছর দেড়েক পার হয়ে গেলও প্রকল্পের তেমন কোন অগ্রগতি না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ভোরের আলোর কাজ নিয়ে তিনি যে সন্তুষ্ট নন তা কড়া ভাষায় রাজ্য পর্যটন মন্ত্রী গৌতম দেবকে জানিয়ে দেন তিনি। মুখ্যমন্ত্রীর ধমক শুনেই কাজে জোর দেয় পর্যটন দপ্তর। আগের বার উত্তরবঙ্গ সফরকালে হাওয়া মহলের কাজ নিয়ে পর্যটন মন্ত্রীকে বকাবকি করেন মুখ্যমন্ত্রী। দ্রুত কাজ শেষ করার পাশাপাশি প্রতিমাসে একবার করে দপ্তরের আধিকারিকদের নিয়ে বৈঠক করার নির্দেশ দেন তিনি। এরপরই প্রথম পর্যায়ে হাওয়া মহল ও ছয়টি কটেজের কাজ শেষ করার সিদ্ধান্ত নেয় পর্যটন দপ্তর। সেইমতো হাওয়া মহলের কাজ ইতিমধ্যে শেষ হলেও দ্রুত গতিতে চলছে ছয়টি কটেজ তৈরির কাজ। এই ছয়টি কটেজের মধ্যে চারটি পর্যটকদের জন্য এবং দুটি ভিভিআইপি কটেজ তৈরি করা হচ্ছে। এলাকায় মোবাইল নেটওয়ার্কের সমস্যা থাকায় বেসরকারি সার্ভিস প্রোভাইডারদের সঙ্গে বৈঠক করে টাওয়ার লাগানোর নির্দেশ দিয়েছে পর্যটন দপ্তর। এছাড়াও ইন্টারনেট পরিষেবা চালু করার তোড়জোড় শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে কয়েকটি বেসরকারি সার্ভিস প্রোভাইডার তাদের কাজ শুরু করেছে। বসানো হচ্ছে ফ্লাইং টাওয়ার।অন্যদিকে শিলিগুড়ি থেকে গাজোলডোবা যাওয়ার রাস্তার মেরামতি এবং উন্নতিকরণের কাজ দেওয়া হয়েছে একাধিক দপ্তরকে। দ্রুত কাজ শেষ করার চেষ্টা শুরু করেছে পর্যটন দপ্তর। সেচ দফতরকে প্রকল্পের মধ্যের রাস্তাঘাট তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও পুকুরের উন্নতিকরণ এবং জলের ব্যবস্থা করতে বলা হয়েছে। ভোরের আলো থেকে আমবাড়ি পর্যন্ত রাস্তার মেরামতি এবং ডুয়ার্স থেকে পৃথক রাস্তা তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে পূর্তদপ্তরকে। বৈকুণ্ঠপুর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে সরস্বতীপুর চা বাগান হয়ে ১২ কিলোমিটার রাস্তার জন্যে বনদপ্তরকে ৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে রাজ্য। এই রাস্তা পরবর্তীতে বেঙ্গল সাফারিতে গিয়ে মিলিত হবে। তখন জঙ্গল সাফারিও শুরু হবে। বর্তমানে ওই এলাকা শিলিগুড়ি মেট্রোপলিটন পুলিশের এনজেপি থানার মিলনপল্লী ফাঁড়ির অন্তর্গত। কোনো সমস্যা দেখা দিলে শিলিগুড়ি থেকে ফোর্স পাঠাতে হয়। কিন্তু ভোরের আলোর কাজ শেষ হয়ে গেলে দেশ বিদেশ প্রচুর পর্যটকেরা আসবেন বলে আশাবাদী রাজ্য। তাই পর্যটকদের সুরক্ষার কথা মাথায় রেখে পৃথক ফাঁড়ি গড়ার নির্দেশ দিয়েছে রাজ্য। এছাড়াও ২৪ ঘন্টা বিদ্যুৎ পরিষেবারও ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে শিল্পপতিরা ওই এলাকায় জমি নিয়ে বিনিয়োগও শুরু করে দিয়েছেন। তৈরি হচ্ছে একাধিক রিসর্ট,রেস্টুরেন্ট,হোটেল। এছাড়াও ওই এলাকায় তৈরি করা হবে একটি হেলিপ্যাড। ভোরের আলো থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে তৈরি হবে এই হেলিপ্যাড।
পর্যটন দপ্তর সূত্রে খবর, ধিরে ধিরে ওই এলাকায় আয়ুর্বেদিক স্পা, ইয়ুথ হস্টেল, হসপিটালিটি ট্রেনিং সেন্টার, বার্ড ওয়াচিং সেন্টার,গলফ কোর্স,বোটিং চালু করারও পরিকল্পনা রয়েছে। যদিও তা পরবর্তী ধাপে চালু করার প্রস্তাব রয়েছে। অন্যদিকে, কাছেই বৈকুণ্ঠপুর জঙ্গল হওয়ায় প্রায়ই এলাকায় হাতির উৎপাত লক্ষ করা যায়। তাই বনদপ্তরকেও সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। প্রয়োজনে এলাকায় বনদপ্তরের ক্যাম্প রাখারও পরিকল্পনা রয়েছে।
পর্যটনমন্ত্রী গৌতম দেব বলেন,"ভোরের আলো মুখ্যমন্ত্রীর স্বপ্নের প্রকল্প। উত্তরবঙ্গের পর্যটনকে এক অন্য মাত্রা দেবে এই প্রকল্প। পর্যটকদের জন্যে মোট ৩০ টি কটেজ তৈরি করার প্রস্তাব রয়েছে। প্রথম পর্যায়ে ৬টি কটেজ তৈরি করছি আমরা। তার মধ্যে দুটি ভিভিআইপি কটেজ রয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ রয়েছে দ্রুত কাজ শেষ করতে হবে। তাই দ্রুত গতিতে কাজ করা হচ্ছে।"
উত্তরবঙ্গে পর্যটন ব্যবসায়ীদের সংগঠন এতোয়ার সভাপতি দেবাশিস মৈত্র বলেন," কাজ শেষ হলে উত্তরবঙ্গের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র হবে গাজোলডোবা। রাজ্য সরকারের এই সদর্থক পদক্ষেপ উত্তরের পর্যটন ব্যবসায়ীদের কর্মসংস্থানেও সহায়তা করবে।"