প্রতিবছর যেমন হয়, তেমন ভাবেই শুরু হয়েছিল ত্রিপুরার চন্দ্রপুর উচ্চমাধ্যমিক স্কুলের দশম শ্রেণির মাধ্যমিক। কিন্তু তারপর এমন ঘটনার সাক্ষী থাকলেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক বাদল চক্রবর্তী, তাঁর ৩২ বছরের শিক্ষকতার জীবনে এমন ঘটনা নজির বিহীন।
প্রলয় দে, মাতাবাড়ি স্কুলের ১৭ বছরের ছাত্র, পরশদের পরীক্ষায় বসেছে এ বছর। দু হাতের গঠন অস্বাভাবিক, সে হাত দিয়ে লেখা তো দূরের কথা, ভাল করে কিছু ধরতেই পারে না প্রলয়। তা বলে কি পরীক্ষা দেবেনা? পায়ের আঙ্গুল দিয়েই পরীক্ষা দিল প্রলয়।
"আমাকে আগেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল প্রলয় বেঞ্চে লিখতে পারবে না, তাই কাঠের বেদী দেওয়া হয়েছিল তাকে। স্পেশাল ইনভিজিলেটরের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। পরীক্ষা শুরুর দিন প্রথম ৩০ মিনিট আমি ওর পাশে বসেছিলাম। সমস্ত প্রতিবন্ধকতা ও শুধু সাহস দিয়ে জয় করে নিয়েছে। আশা করছি, মাধ্যমিকের পর একাদশ শ্রেণিতে ও আমার স্কুলেই ভর্তি হবে।
প্রলয়ের বাবা সুজন কুমার দে পেশায় দিনমজুর। মা পুতুল গুহ দে অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী। মূলত মায়ের রোজগারে সংসার চলে। প্রলয়ের পড়াশোনার খরচ, বড় দিদির কলেজে পড়ার খরচ, সংসারের বাকি খরচাপাতি সবই চালাতে হয় মাসিক ৯০০০ টাকা রোজগারের মধ্যেই।
আরও পড়ুন, শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়েও বারবার লেখা যায় ইতিহাস, প্রমাণ করলেন অরুণিমা
"চিকিৎসক এবং নার্সেরা প্রলয়ের জন্মের পর ওকে আমার কাছে নিয়ে আসেনি প্রথম দু'দিন। প্রথম যখন দেখি, আমি অজ্ঞান হয়ে গেছিলাম। ওর হাত দুটো দেহের পেছন দিকে বাঁকানো", ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে জানিয়েছেন প্রলয়ের মা। জানিয়েছেন জন্মের পর সবাই ভেবেছিল প্রলয়ের বাঁচার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। "ওর বাবাও মনে করত আমাদের ছেলে কিছুই শিখতে পারবে না, ক্রমশ অসহায়তা গ্রাস করবে ওকে, কিন্তু আস্তে আস্তে ওকে লেখাপড়া শেখাতে শুরু করি আমরা"।
প্রলয়ের অসুখটি বড়ই বিরল। চিকিৎসা করাতে গিয়ে ফল হয়েছিল বিরূপ। হাতগুলো ক্রমশ সরু হতে শুরু করে তারপর থেকেই। চিকিৎসা যখন বন্ধ করা হল, ততদিনে হাত একেবারে একটা হাড়ে পরিণত হয়েছে। দু হাতেই একটা করে আঙ্গুল রয়েছে প্রলয়ের। তাই খাবার সময় চামচ ধরতে হলেও কনুই দিয়ে ধরতে হয়।
খুব তাড়াতাড়ি লেখাপড়া রপ্ত করে নিয়েছিল প্রলয়। মায়ের কথায়, "তিন বছর বয়সের মধ্যেই ও বাংলা ইংরেজি হরফ লিখতে শিখে গিয়েছিল", মাধ্যমিকের টেস্টে প্রলয় ৮০ শতাংশের বেশি নম্বর পেয়েছে। হ্যাঁ পায়ের দু'আঙ্গুলের মাঝে কলম ধরেই লেখে সে। স্বপ্ন দেখে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়ে একদিন অধ্যাপক হবে। "আমি নিজের মধ্যে কোন খামতি অনুভব করতেই পারি না। আমার মা, আমার শিক্ষকরা আমায় এত ভাল ভাবে শিখিয়েছেন। নিজের সেরাটুকু দেওয়ার চেষ্টা করেছি আমি। রোজ অন্তত ২ ঘণ্টা লেখার অভ্যাস করতাম। এখন পা দিয়ে লিখতে কোনও অসুবিধে হয় না আমার"।
Read the full story in English