দুয়ারে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডাকে ইতিমধ্যেই রাজধানীর বুকে বিরোধী জোটের বৈঠক শুরু হয়েছে। গাত ও জোড়াফুলের বৈরী সমপ্রক্ হলেও কংগ্রেসের প্রতিনিধিরা এ দিন বৈঠকে যোগ দিয়েছেন। রয়েছেন বাম দলগুলির প্রতিনিধিরাও। এই বৈঠক থেকেই এনডিএ বিরোধী শিবিরের রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী চূড়ান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু সূতৃণমূল সুপ্রিমোর ডাকা এই বৈঠকে যোগ দিলেন না বেশ কয়েকটি বিরোধী রাজনৈতিক দল। যেমন, ওয়াই এস জগনমোহনের (অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী) ওয়াইএসআর কংগ্রেস, অরবিন্দ কেজরিওয়ালের (দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী) আম আদমি পার্টি, নবীন পট্টনায়েকের (ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী) বীজু জনতা দল ও কেসিআরের (তেলেঙ্গানা মুখ্যমন্ত্রী) টিআরএস। ওয়াইএসআর কংগ্রেস বর্তমানে অন্ধ্রপ্রদেশের শাসক দল। বিজেডি ও টিআরএসের দখলে যথাক্রমে ওড়িশা ও তেলেঙ্গানা। আপের শাসন দিল্লি ও পাঞ্জাবে প্রতিষ্ঠিত।
নজরে ২০২৪। রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়ে যখন মমতা ও সনিয়ার দল বিরোধী জোটের সলতে পাকানোর কাজ সারতে চাইছেন তখন এ দিন তৃণমূল নেত্রীর ডাকা বৈঠকে এই চার দলের অনুপস্থিতি নানা প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে। দৃশ্যতই স্বস্তিতে বিজেপি। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তাদের প্রার্থীই হাসতে হাসতে জয়ী হবেন বলে দাবি গেরুয়া নেতৃত্বের।
খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিজেপি তথা এনডিএ জোট বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাদের চিঠি দিয়েছিলেন এ দিনের বৈঠকে আসার জন্য। তবুও জহন মোহন, নবীন পট্টনায়েক, টিআরএস, কেজরিওয়ালের প্রতিনিধিরা বৈঠকে যোগ দিলেন না। কেন? বাধ্যবাধকতা, বিরোধী জোটের অন্যান্য দলের মধ্যে লড়াই, নাকি কোনও জোটে না থেকে নিজেদের স্বাতন্ত্র অবস্থান বজায় রাখতে চাইছে এই দলগুলি?
বিজু জনতা দল
নবীন পট্টনায়কের বিজেডিকে সভায় আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। তারপরও সম্ভবত তৃণমূল নেত্রী জানতেন যে, তিনি রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী নিয়ে বিরোধীদের বৈঠকে কোনও প্রতিনিধি পাঠাবেন না।
বিজেডি, প্রকাশ্যে বিজেপি এবং বিরোধীদের থেকে সম-দূরত্বের নীতি বজায়ে বিশ্বাসী। কেন্দ্রের সঙ্গে সংঘাতের পথে যেতে চায় না ওড়িশার এই শাসক দল। এমনকি সংসদে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিল পাশেও বিজেপিকে সমর্থন করেছে বিজেডি। নবীন জানেন বিজেপি ওড়িশায় পোক্ত সংগঠন ও ভোটে জিততে মরিয়া চেষ্টা করেছিল। ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে গেরুয়া বাহিনী সেই রাজ্যে কিছুটা সাফল্যের স্বাদ পেয়েছিল।
কিন্তু বিজেডি রাজ্য রাজনীতি ও জাতীয় রাজনীতিকে ভিন্নভাবে দেখতে পছন্দ করে।
২০১৭ সালে এনডিএ জোটের প্রার্থী রাম নাথ কোবিন্দকে সমর্থন করেছিল বিজেডি। শাসক দলের একাধিক নেতৃত্বের দাবি, নবীন পট্টনায়েকের দলীয় সংগঠন ওড়িশায় খুব শক্তিশালী এবং তিনি কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের প্রতি অ-সংঘাতপূর্ণ অবস্থান নিয়েছেন। প্রয়োজনে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএর বিরুদ্ধাচারণও করতে সক্ষম। অর্থাৎ সমান-দূরত্বের অবস্থানেই অটল থাকবে বিজেডি।
ওয়াইএসআর কংগ্রেস পার্টি
জগন মোহন রেড্ডির নেতৃত্বাধীন দলের বিষয়টি ভিন্ন। বিরোধী নেতারা অভিযোগ করেন যে তিনি বিজেপির সঙ্গে সমঝোতা করে থাকেন। কারণ এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের হাতে তাঁর বিরুদ্ধে আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীন সম্পত্তি মামলা রয়েছে। ফলে এনডিএ জোটে না থাকলেও বিজেপির কেন্দ্রীয় সরকার জগন মোহনকে সহজেই নিয়ন্ত্রণে সক্ষম।
অন্ধ্রপ্রদেশে কংগ্রেস আর ফ্যাক্টর নয়। জগনের সামনে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী টিডিপি। অতীতে বিজেপির সঙ্গে জোটে ছিল টিডিপি। চন্দ্রবাবু নাইডুর দল যাতে কেন্দ্রের কাছাকাছি চলে না আসে সেটা নিশ্চিৎ করাও জগনের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ। ফলে জগনের অবস্থান বিজেপির কাছে অনেকটাই স্বস্তির।
পট্টনায়েক এবং জগান উভয়েই দিন কয়েক আগেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন এবং বিজেপি বিশ্বাস করে যে উভয়ই এনডিএ মনোনীত রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থীকে সমর্থন করবে।
তেলেঙ্গানা রাষ্ট্রীয় সমিতি
কে চন্দ্রশেখর রাও-এর নেতৃত্বাধীন টিআরএস-এর মামলাটি আরও নজরকাড়া।
একসময় টিআরএস বিজেপির সঙ্গী ছিল। কিন্তু তেলেঙ্গানায় বিজেপির মরিয়া জায়গা তৈরি চেষ্টা কেসিআরকে অবস্থান পরবির্তনে বাধ্য করেছে। তেলেঙ্গানায় কংগ্রেসের এখনও শক্তিশালী সংগঠন রয়েছে। কিন্তু টিআরএস হাত ধরতে রাজি নয়। অন্যদিকে বিজেপিকেও জায়গা ছাড়লে চলবে না। অন্যদিকে আবার চন্ত্রশেখর রাওয়ের জাতীয়স্তরের রাজনীতিতেও উচ্চাকাঙ্ক্ষা রয়েছে। ফলে বেশ কিছুআঞ্চলিক দলের সঙ্গে টিআরএসকে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখতেই হবে।
যে আলোচনায় কংগ্রেস রয়েছে সেখানে টিআরএসের প্রতিনিধিরা যাবে না। এ দিন মমতার ডাকা বৈঠকে থাকবেন হাতের শীর্ষ কয়েকজন নেতা। ফলে শুধঘু বিজেপি বিরোধীতায় এই বৈঠকে যেতে নারাজ কেসিআরের নেতারা। যদিও বিরোধী নেতারা বিশ্বাস করেন যে টিআরএস বিরোধী দলের মনোনীত প্রার্থীকেই সমর্থন জানাবেন এবং বিরোধীদের বৈঠক এড়ালেও বিজেপির বিরোধী "বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থবাহী" লড়াইয়ে থাকবে।
টিআরএস ২০১৭ সালে এনডিএ মনোনীত প্রার্থীকেই সমর্থন করেছিল।
আম আদমি পার্টি
দিল্লি এবং পাঞ্জাবে ক্ষমতায় থাকা আপেরও মমতার ডাকা কনস্টিটিউশন ক্লাবের বৈঠকে যেতে দ্বিধা রয়েছে। আপ অন্য দলগুলির থেকে স্বতন্ত্র। আপাতত এই বিষয়টিই পোক্ত করতে মরিয়া দুই রাজ্যের ক্ষমতাসীন কেজরিওয়ালের দল। ফলে আপ বিরোধী দলগুলির অংশ হতে পছন্দ করছে না। কিন্তু আপের সঙ্গে কংগ্রেসের বিরোধ রয়েছে। আসলে, আপ অনেক রাজ্যেই কংগ্রেসের জায়গা নিতে চেষ্টা চালাচ্ছে। তবে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী এবং এএপি প্রধান অরবিন্দ কেজরিওয়ালের সম্পর্ক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে ভাল। সম্ভবত কিছু বিরোধী দলের সঙ্গে রাষ্ট্রপতি ভোটের পদপ্রার্থী নিয়ে অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগে থাকবেন কেজরিওয়াল।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচন সংক্রান্ত বিরোধী শিবিরের বৈঠকে হাজির রয়েছেন- মল্লিকার্জুন খাড়গে, জয়রাম রমেশ এবং রণদীপ সুরজেওয়ালা (কংগ্রেস), মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, যশবন্ত সিনহা ও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় (টিএমসি), দীপঙ্কর ভট্টাচার্য (সিপিআইএমএল), সুভাষ দেশাই ও প্রিয়াঙ্কা চতুর্বেদী (শিবসেনা), এন কে প্রেমচন্দ্রন এবং মনোজ ঝাড় (আরএসপি), ড. ওমর আবদুল্লাহ (এনসি), বিনয় বিশ্বম (সিপিআই), এইচডি দেবগৌড়া এবং কুমারস্বামী (জেডিএস), টিআর বালু (ডিএমকে), অখিলেশ যাদব (এসপি), মেহবুবা মুফতি (পিডিপি)।