বছর ষাটেকের মনসা বিশ্বাস বসে আছেন নীল রতন সরকার হাসপাতালের ই.এন.টি বিভাগের সিঁড়িতে। তাঁর কানের নিচ দিয়ে গলা অবধি ঝুলছে প্রকান্ড একটি টিউমার, যন্ত্রনায় গোঙাচ্ছেন। যা দেখে এড়িয়ে যেতে পারেননি ঐ বিভাগের প্রধান চিকিৎসক তপনকান্তি হাজরা। রাতারাতি ওই বৃদ্ধাকে ভর্তি করে অপারেশন করার সিদ্ধান্ত নেন ডাক্তারবাবু। অত্যন্ত সুখের কথা, বর্তমানে ওই টিউমারটি কেটে বাদ দেওয়া সম্ভব হয়েছে।
আরও পড়ুন: হিন্দু হস্টেল অধরাই, তবে ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া ধরা দিচ্ছে প্রেসিডেন্সি আবাসিকে
পয়সার অভাব, সঙ্গে কাটাছেঁড়ার ভয়, সব মিলিয়ে টিউমারটির জন্য কোনো রকম চিকিৎসা করে উঠতে পারেননি মনসা। আত্মীয় পরিজন বলতে এক বোনঝি ছাড়া কেউ নেই। পেটের দায়ে ওই টিউমার নিয়েই মধ্যমগ্রাম এলাকায় বাড়ি বাড়ি কাজ করে বেড়াতেন ওই বৃদ্ধা। টিউমারের আকৃতি তাঁর অন্য এক পরিচয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু আর ওই টিউমারের ভার বইতে পারছিলেন না। কারণ দিনকয়েক ধরে চড়চড় করে বাড়ছিল টিউমারের আয়তন।
অগত্যা কষ্ট সহ্য করতে না পেরে এসে পৌঁছন নীল রতন সরকারের দরবারে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকার পর ডঃ হাজরার চোখে পড়েন বৃদ্ধা। ব্যাথা যন্ত্রণায় কাতর তখন। চিকিৎসকের আরো চোখে পড়ে, পাশে একটি গামছা, তাতে আসতে যেতে টাকা ফেলে দিয়ে যাচ্ছেন অনেকেই। হয়ত এভাবেই চিকিৎসা করার টাকা জোগাড় করছিলেন মনসা।
চিকিৎসক ওই বৃদ্ধার প্রাথমিক শারীরিক অবস্থা দেখে জুনিয়ার ডাক্তারদের ডেকে পাঠান। বিলম্ব না করে বিভাগের বাকি সদস্যদের সঙ্গে পরামর্শ করে অস্ত্রোপচার করার সিদ্ধান্ত নেন সেদিনই। রাতারাতি নীলরতন সরকার হাসপাতালেই ভর্তি করা হয় বৃদ্ধাকে। অস্ত্রোপচারের জন্য নীলরতন সরকার হাসপাতাল সুপারের সহযোগীতায় বিনামূল্যেই করা হয় প্রয়োজনীয় পরীক্ষানিরীক্ষা। জামাকাপড় থেকে শুরু করে খাবারের থালা বাটিও জোগাড় করে দেন ওই বিভাগের চিকিৎসকরাই। টিউমার অস্ত্রোপচারে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়ে থাকে, তাই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সহযোগীতায় বিনাপয়সায় প্রয়োজনীয় রক্তের জোগানও দিয়েছেন ডাক্তাররাই। গত মাসের ৩০ তারিখ অস্ত্রোপচার করে বাদ দেওয়া হয়েছে টিউমারটিকে।
ডঃ হাজরা বলেন, "টিউমারের বয়স ২০ থেকে ২১ বছর। এতদিন ধরে রেখে দেওয়ায় অভ্যন্তরীন নানা সংক্রমণ হয়ে যায়। যার ফলে অস্ত্রোপচারের সময় রক্তক্ষরণ হয় অনেক। প্যারোটিড লালাগ্রন্থি, অর্থাৎ যে স্থানে মাম্পস হয়, সেখানেই টিউমারটি বৃহদাকার অবস্থা নিয়েছিল। যার ফলে দুটি ফেসিয়াল স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারত, তবে তা হয় নি। তিনি আরও বলেন, "একদম সাদা কথায়, আষাঢ়ের দুটো তালের সম আয়তনের ছিল টিউমারটি, ওজন কম করে চার কেজি। টিউমার ঝুলে পৌঁছে গিয়েছিল বুক অবধি।"
সকাল দশটা থেকে দুপুর আড়াইটে অবধি চিকিৎসকদের একটি টিম, যাতে ডঃ হাজরা ছাড়াও ছিলেন অনিরুদ্ধ মজুমদার, শুভ্রকান্তি সেন, সোনিয়া বন্দোপাধ্যায়, সুচিতা চৌধুরি, এবং অমৃতেন্দু কমল মাইতি, অস্ত্রোপচার সম্পন্ন করেন। সম্প্রতি টিউমারটি পরবর্তী পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। যেখানে খতিয়ে দেখা হবে আদৌ টিউমারটিতে ক্যান্সারের কোষ আছে কিনা। প্রাথমিকভাবে ডঃ হাজরা জানিয়েছেন, ক্যানসার না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। মনসা বিশ্বাস বর্তমানে সুস্থ আছেন। আর দিন কয়েকের মধ্যেই হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাবেন তিনি।