কেন্দ্রীয় সরকারের একটি স্বাস্থ্য বীমা প্রকল্প হল আয়ুষ্মান ভারত। ২০১৮-র ২৩ সেপ্টেম্বর গোটা দেশ জুড়ে কার্যকর করা হয়েছিল এই প্রকল্প। অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষদের স্বাস্থ্য বীমা প্রদান করার উদ্দেশেই এই প্রকল্প চালু করা হয়েছিল। আয়ুষ্মান কার্ড থাকলে প্রতি বছর ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত বিনামূল্যে স্বাস্থ্য বীমার সুবিধা পান সুবিধাভোগীরা।
সরকার বিশ্বাস করে যে শুধুমাত্র একটি সুস্থ ভারত বিশ্ব প্রতিযোগিতায় সফল হতে পারে। সকল শ্রেণীর মানুষের জন্য সাশ্রয়ী মূল্যের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যেই সরকার প্রধানমন্ত্রী আয়ুষ্মান ভারত স্বাস্থ্য বীমা প্রকল্প নিয়ে এসেছে। প্রতি বছর এই প্রকল্পের মাধ্যমে সুবিধাভোগী পরিবাররা ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত একটি কভারেজের সুবিধা পান।
এই স্কিমের সুবিধাগুলি যে কোনও সরকারি হাসপাতাল বা তালিকাভুক্ত বেসরকারি হাসপাতালে নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু সাম্প্রতিক রিপোর্টে উঠে এসেছে এক চাঞ্চল্যকর তথ্য। আয়ুষ্মান ভারত সুবিধাভোগীদের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি রোগী ‘প্রাইভেট কেয়ার অ্যাক্সেস’ অর্থাৎ বেসরকারি খাতে চিকিৎসা পরিষেবা পেতেই কেন্দ্রের এই প্রকল্পটিকে করেছিলেন। কোভিড-পরবর্তী ক্ষেত্রে খরচ সরকারি হাসপাতালের চেয়ে বেসরকারি হাসপাতালে প্রায় দ্বিগুণ। অথচ সেই বেসরকারি হাসপাতালেই আয়ুষ্মান ভারত সুবিধাভোগীরা পরিষেবা নিতে এই প্রকল্পকে কাজে লাগিয়েছেন।
রিপোর্ট অনুসারে জানা গিয়েছে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে কেন্দ্রের বিনামূল্যে স্বাস্থ্য বিমা প্রকল্প আয়ুষ্মান ভারত চালু হওয়ার ছয় বছরে পর গরীবদের চিকিৎসা খাতে সরকার যে অর্থ ব্যয় করেছে তার এক- চতুর্থাংশেরও বেশি পাঁচটি রোগের চিকিৎসা খাতে ব্যয় হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে হৃদরোগ, জেনারেল মেডিসিন, শল্য চিকিৎসা, হাড়ের চিকিৎসা এবং ক্যান্সার। এই পাঁচটি রোগের চিকিৎসা খাতে সরকারকে ব্যায় করতে হয়েছে মোট ২০,৯৫১ কোটি টাকা যা প্রকল্পের মোট ব্যায়ের ৭২,৮১৭ কোটি টাকার ২৮ শতাংশ।
গ্রামীণ ভারতে সরকারি হাসপাতালে ক্যান্সারের জন্য চিকিৎসা ব্যয় গড়ে ২৩,৯০৫ টাকা এবং যেখানে বেসরকারি হাসপাতালে এই ব্যায় ৮৫,৩২৬ টাকা। যা প্রায় তিনগুণ বেশি। হৃদরোগের ক্ষেত্রে বেসরকারি হাসপাতালে খরচ গড়ে প্রায় ৪২,৭৫৯ টাকা যা একটি সরকারি হাসপাতালের প্রায় ছয় গুণ। সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে হৃদরোগ বা কার্ডিওভাসকুলার রোগে ভারতে ২৮.১ শতাংশ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। শ্বাসযন্ত্রের অসুস্থতার কারণে মৃত্যুর হার ১০ শতাংশ, ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর হার ৮.৩ শতাংশ। স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যহার ৭.১ শতাংশ এবং ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে এই হার ৩ শতাংশ। সামগ্রিকভাবে, এই ধরনের রোগে আক্রান্ত হয়ে ভারতে প্রতিবছর প্রায় মোট মৃত্যুর ৬৩ শতাংশ মানুষের মৃত্যু হয়।
আরও পড়ুন : < Lok Sabha Election 2024: বাংলার ৪২ কেন্দ্রে তৃণমূল প্রার্থী কারা? একনজরে সম্ভাব্য তালিকা >
বিপুল সংখ্যক মানুষ আয়ুষ্মান ভারত স্বাস্থ্য সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে মানুষ বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন চিকিৎসা করাতে। শহুরে এলাকার প্রায় ৬০শতাংশ পাশাপাশি গ্রামীণ এলাকার ৫২ শতাংশ মানুষ আয়ুষ্মান ভারত স্বাস্থ্য বীমা প্রকল্পের সুবিধা নিচ্ছেন বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা পরিষেবা নেওয়ার মাধ্যমে। দেশের একটা বড় অংশের মানুষ এই প্রকল্পের মাধ্যমে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে। আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্প মানুষের স্বাস্থ্যসেবার খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করেছে। সরকারের নিজস্ব তথ্য অনুসারে দেখা যায় যে, বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যয় সরকারি হাসপাতালের তুলনায় গড়ে ৬-৮ গুণ।
২০১৮ সাল থেকে এই প্রকল্পের অধীনে মোট ৭২,৮১৭ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। এর মধ্যে ৪৮,৭৭৮ কোটি টাকা যা মোট ব্যায়ের প্রায় ৬৭% বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা খাতে খরচ হয়েছে। দক্ষিণের ৫ রাজ্য তামিলনাড়ু, কেরল, কর্ণাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ এবং তেলেঙ্গানায় সারা দেশে আয়ুষ্মান কার্ডের মাত্র ১৭ শতাংশ সুবিধাভোগী রয়েছেন। কিন্তু এই পাঁচটি রাজ্য থেকেই রোগীদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি প্রায় ৫৩ শতাংশ। গত পাঁচ বছরে এই প্রকল্পের সুবিধা নেওয়া মোট ৫.৪৭ কোটি রোগীর মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশই কর্ণাটক, তামিলনাড়ু, কেরল, অন্ধ্রপ্রদেশ এবং ছত্তিশগড়ের।
তথ্যের অধিকার (আরটিআই) আইনের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য এবং নথির বিশ্লেষণ দেখায় যে ৫.৪৭ কোটি রোগী ২০১৮ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে এই প্রকল্পের অধীনে চিকিৎসা পরিষেবার সুবিধা পেয়েছেন। প্রথম তিন বছরে বার্ষিক গড় প্রায় ৪৯ লাখ রোগী থাকলেও পরবর্তী তিন বছরে তা বৃদ্ধি পেয়েছে অনেকটাই। প্রতি বছর গড়ে ১.৩৩ কোটি রোগী এই প্রকল্পের অধীনে চিকিৎসা সুবিধা নিচ্ছেন। দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের তথ্যের অধিকারের অধীনে প্রাপ্ত অফিসিয়াল রেকর্ড ও ডেটার ভিত্তিতে উঠে এসেছে এই তথ্য। এখনও পর্যন্ত ৩২.৪০ কোটি মানুষকে আয়ুষ্মান ভারত কার্ড দেওয়া হয়েছে।
এই স্কিমের অধীনে সর্বাধিক ৪,২২২ কোটি টাকা কার্ডিওভাসকুলার বা হৃদরোগ সংক্রান্ত ক্ষেত্রে, ৪১০০ কোটি টাকা জেনারাল মেডিসিনের ক্ষেত্রে, ৩৮৯৫ কোটি টাকা জেনারেল সার্জারি খাতে, ৩৫৬০ কোটি টাকা অর্থোপেডিকস বা হাড়ের চিকিৎসা খাতে এবং ২৬১১ কোটি টাকা ক্যানসার চিকিৎসা খাতে খরচ হয়েছে।
২০১৮ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ডেটা বিশ্লেষণে দেখা গেছে যে ১০ টি রাজ্যে মোট রোগীদের ৮০ শতাংশ মানুষ যারা এই স্কিমের অধীনে চিকিৎসা পেয়েছেন। তার মধ্যে রয়েছে তামিলনাড়ু, কর্ণাটক, কেরল, অন্ধ্রপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ, উত্তর প্রদেশ, গুজরাট, ঝাড়খণ্ড এবং পাঞ্জাব। এর মধ্যে ছয়টি, ছত্তিশগড় সহ এবং কর্ণাটক বাদে অ-বিজেপি রাজ্যের মানুষ এই সুবিধা পেয়েছেন।