আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৪ জন ছাত্রের বিরুদ্ধে বুধবার দেশদ্রোহিতা এবং অন্যান্য অভিযোগ আনা হয়েছে। এঁদের বিরুদ্ধে ভারত বিরোধী, পাকিস্তানপন্থী শ্লোগান দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে। এএমইউয়ের কিছু ছাত্র সাংবাদিকদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েন। মঙ্গলবার ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন আসাদুদ্দিন ওয়াইসি। ওয়াইসির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে বুধবার প্রতিবাদ কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছিল। পুলিশের বক্তব্যানুসারে, হিংসা ছড়িয়ে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরের বাইরেও এবং আন্দোলনকারী ছাত্রদের হাতে নিগৃহীত হন এক বিজেপি যুব সংগঠনের কর্মীও।
ভারতীয় দণ্ডবিধিতে দেশদ্রোহিতা
ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪ এ ধারানুসারে দেশদ্রোহিতা- কোনও কথা বলে বা অন্য কোনও ভাবে ঘৃণা ছড়ানোর বা সম্মানহানির চেষ্টা করলে, অথবা উত্তেজনা ছড়িয়ে বা উত্তেজনা ছড়ানোর চেষ্টা করে সরকারের প্রতি বিরাগ প্রকাশ করলে এই আইন প্রযোজ্য। এই আইনের তিনটি ব্যাখ্যাও রয়েছে। বলা হয়েছে- বিশ্বাসঘাতকতা বা শত্রুতা 'বিরাগ'-এর মধ্যে পড়লেও, যেসব মন্তব্য ঘৃণা ছড়ানোর জন্য় নয়, বা উত্তেজনা ছড়ানোর জন্য নয়- তেমন মন্তব্য সম্মানহানিকর বা বীতরাগপূর্ণ হলেও তা এই অপরাধের আওতায় পড়বে না।
আরও পড়ুন, সরকারের সমালোচনা মানেই দেশদ্রোহিতা নয়: আইন কমিশন
দেশদ্রোহিতা একটি বিচার্য এবং জামিন অযোগ্য অপরাধ এবং এ অপরাধে সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হতে পারে, জরিমানা হতেও পারে, বা না হতেও পারে। ১৮৬০ সালে যে প্রথম ভারতীয় দণ্ডবিধি কার্যকর হয়েছিল, তাতে দেশদ্রোহিতা ছিল না। ১৮৭০ সালে ভারতীয় দণ্ডবিধিতে দেশদ্রোহিতা প্রথমবার প্রবেশ করে- তখন বলা হয়েছিল, ভুলবশত ১৮৬০-এর দণ্ডবিধির খসড়া থেকে এই আইন বাদ পড়ে গিয়েছিল।
ব্রিটিশ রাজের সময়ে কীভাবে দেশদ্রোহিতা আইন বলবৎ হত?
জাতীয়তাবাদী কণ্ঠস্বর এবং স্বাধীনতার দাবিকে দমিয়ে রাখার জন্য খুবই কার্যকর ছিল এই আইন। বাল গঙ্গাধর তিলক, মহাত্মা গান্ধী, ভগৎ সিং এবং জওহরলাল নেহরুর মত জাতীয় নায়কদের বিরুদ্ধে এই আইন কাজে লাগানো হয়েছিল। বাল গঙ্গাধর তিলক তাঁর নিজের সংবাদপত্র কেশরীতে দেশের দুর্ভাগ্য শীর্ষক একটি নিবন্ধ লেখায় প্রিভি কাউন্সিল তাঁকে দেশদ্রোহিতার দায়ে ৬ বছরের জন্য জেলে পাঠিয়েছিল।
১৯৩৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত এবং লন্ডনে অবস্থিত প্রিভি কাউন্সিল অবশ্য দেশদ্রোহিতাকে ভিন্ন ভাবে ব্যাখ্যা করে। ১৯৪২ সালে নীহারেন্দু দত্ত মজুমদার বনাম রাজ মামলায় যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত বলে, জনগণের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির উদ্দেশ্য থাকলেই, তাকে দেশদ্রোহিতা বলে গণ্য করা যায়। এই প্রস্তাব অবশ্য ১৯৪৭ সালে রাজ বনাম সদাশিব নারায়ণ ভালেরাও মামলায় পাল্টে দেয় প্রিভি কাউন্সিল।
তিলক মামলায় প্রিভি কাউন্সিল বলেছিল হিংসায় ইন্ধন জোগানো দেশদ্রোহিতার অপরাধের পূর্বশর্ত নয়। বলা হয়েছিল, সরকারের বিরুদ্ধে শত্রুতার বোধ নিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টিই ১২৪ এ ধারায় অপরাধের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ পূর্বশর্ত হিসেবে গণ্য।
স্বাধীনতা পরবর্তীতে শীর্ষ আদালত ১২৪এ ধারাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করেছে?
১৯৬২ সালে সুপ্রিম কোর্টে একটি মামলা ওঠে। কেদার নাথ সিং বনাম বিহার সরকারের ওই মামলায় কারাদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়েছিল কেদার নাথকে। তিনি শীর্ষ আদালতের শরণাপন্ন হন। তাঁর একটি ভাষণকে কেন্দ্র করে অভিযোগ দায়ের হয় কেদার নাথের বিরুদ্ধে। ওই ভাষণে কেদার নাথ বলেছিলেন, ”আজ বারাউনির চারপাশে সিবিআইয়ের কুকুরেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। অনেক সরকারি কুকুর আজকের এই সভাতেও বসে রয়েছে। দেশের মানুষ ব্রিটিশদের তাড়িয়ে কংগ্রেসের গুণ্ডাদের গদিতে বসিয়েছে। আমরা ব্রিটিশদের যেমন তাড়িয়েছি, তেমনই এই কংগ্রেসি গুণ্ডাদেরও তাড়াব। ওরা আজ দেশে লাঠি এবং গুলির রাজত্ব স্থাপন করেছে। আমরা বিশ্বাস করি বিপ্লব হবে এবং সে বিপ্লবের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে পুঁজিবাদী, জমিদার আর কংগ্রেসি নেতারা আর সেই ছাইয়ের উপরে আমরা দরিদ্র ও নিপীড়িত মানুষের সরকার গড়ে তুলব।”
শীর্ষ আদালতে তাঁর আবেদনে কেদারনাথ ১২৪ এ ধারার সাংবিধানিক বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন, তাঁর যুক্তি ছিল ভারতের সংবিধানের ১৯ নং অনুচ্ছেদে মত প্রকাশের অধিকার রয়েছে। আদালত এক্ষেত্রে ১২৪ এ ধারার দুটি পরস্পরবিরোধী ব্য়াখ্যার মুখোমুখি হয়। একটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালতে নীহারেন্দু দত্ত মামলা এবং অন্যটি হল প্রিভি কাউন্সিলে সদাশিব নারায়ণ ভালেরাও মামলা। হিংসায় মদত নাকি শৃঙ্খলাভঙ্গের চেষ্টা- ১২৪ এ-র ক্ষেত্রে কোনটি পূর্বশর্ত তা নিয়ে এই দুটি রায়ে পৃথক মতামত দেওয়া হয়েছিল।
এ মামলায় সুপ্রিম কোর্ট কী রায় দিয়েছিল?
১২৪ এ ধারাকে মতপ্রকাশের অধিকারের মধ্যে সীমিত বিধিনিষেধ এনে সাংবিধানিক ভাবে রক্ষা করা যায় কি না, তা খতিয়ে দেখেছিল আদালত। মাথায় রাখা হয়েছিল রাষ্ট্র এবং শৃঙ্খলার প্রশ্নটিকেও। ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪ এ ধারাকে সাংবিধানিক মান্যতা দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট। "আইনবলে প্রতিষ্ঠিত সরকারের ধারাবাহিক অস্তিত্ব বজায় রাখা রাষ্ট্রের স্থিতাবস্থা বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনীয় শর্ত"- বলে মত প্রকাশ করেছিল শীর্ষ আদালত।
তাহলে দেশদ্রোহিতা কী?
সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চ কেদার নাথ সিং মামলায় রায় দিয়েছিল যে সরকারকে ধ্বংস করতে পারে এমন যে কোনও কাজ, হিংসাত্মক উপায়ে করা হলে অথবা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য করা হলে তা দেশদ্রোহিতার আওতায় পড়বে।
কোনও লিখিত অথবা কথিত বক্তব্য যা সরকারকে হিংসাত্মক উপায়ে উৎখাত করার আইডিয়া দিতে পারে, এর মধ্যে বিপ্লব- এর আইডিয়াও পড়বে, তা ১২৪ এ ধারার আওতাভুক্ত অপরাধ বলে গণ্য হবে বলে জানিয়ে দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট।
তাহলে দেশদ্রোহিতা নয় কী?
সরকারের কোনও কাজকে উন্নতি বা পাল্টানোর আইনি চেষ্টায় তার বিরোধিতা করা দেশদ্রোহিতা নয়। যত কড়া ভাষাতেই সরকারের সমালোচনা করা হোক না কেন, হিংসাত্মক উপায়ে বিশৃঙ্খলা তৈরির চেষ্টা না করা হলে তা আইনগত ভাবে অপরাধ নয় বলে জানিয়ে দিয়েছিল শীর্ষ আদালত।
Read the Full Story in English