রাশিয়ার অক্টোবর বিপ্লব ভারতে এবং বিশ্বের অন্যান্য অংশে বামপন্থী মতাদর্শের স্ফুলিঙ্গকে প্রজ্বলিত করেছিল। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে ভারতের রাজনৈতিক চিন্তাধারা গান্ধীবাদী মতাদর্শ এবং উগ্র কমিউনিজমের মধ্যে এতটাই আবর্তিত হয়েছিল যে বাঙালি উগ্র জাতীয়তাবাদী মানবেন্দ্রনাথ রায় বিশ্বব্যাপী কমিউনিজমের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হয়ে ওঠেন।
বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে
অল্প বয়সে তাঁর রাজনৈতিক কর্মজীবন শুরু করার পর, রায় বা নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য প্রথমে ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী উগ্র কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠেন। ১৯১৫ সাল নাগাদ, ইউরোপে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে, তিনি এবং আরও অনেকে নিশ্চিত হয়েছিলেন যে ভারতে ব্রিটিশদের সাথে লড়াই করার একমাত্র উপায় হল জার্মানির সাহায্য লাভ। রায়, এই সময় তহবিল সংগ্রহের জন্য ভারত ছেড়েছিলেন। শীঘ্রই নিজেকে বিশ্বজুড়ে ক্রমবর্ধমান কমিউনিস্ট সংগ্রামের সঙ্গে তিনি ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে পড়েন।
মেক্সিকোতে এমএন রায়
১৯১৫ সালে রায় যখন ভারত থেকে যাত্রা করেন, তখন মেক্সিকো তার সফরসূচিতে ছিল না। তাঁর গন্তব্য ছিল ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপ। কিন্তু, শেষ পর্যন্ত এই সফর অনেকের মত তাঁর জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ১৯১৬ সালের শেষের দিকে চিন, জাপান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপকূলে পৌঁছে যান এমএন রায়। তবে, তিনি নজরদারি থেকে বাঁচতে পারেননি। ১৯১৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। সেই সময় জার্মানির ঘনিষ্ঠ ভারতীয়দের বিশেষ নজরে রাখা শুরু হয়। সেই নজরদারি থেকে বাঁচতে এমএন রায়, অন্যান্য অনেক ভারতীয় বিপ্লবীর মতই আমেরিকা থেকে পালিয়ে দক্ষিণে মেক্সিকোতে চলে যান।
রায়ের কথা
পরবর্তীতে তিনি স্মৃতিকথায় লিখেছেন, 'মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেশী মেক্সিকো, স্থায়ী বিপ্লবের রাজ্য। প্রতিশ্রুতির দেশ বলে আমার মনে হয়েছিল। আমি যদি আরও এগিয়ে যেতে না-ও পারি, তবে আমি সেখানে বসতি স্থাপন করব এবং অন্তত একটি বিপ্লবে অংশ নেব। এটাই ছিল ইচ্ছা। সেই সময় ভারত আর আমার একমাত্র ব্যস্ততা ছিল না। আমি বিপ্লবকে একটি আন্তর্জাতিক সামাজিক প্রয়োজন হিসেবে ভাবতে শিখেছিলাম।'
বই প্রকাশ
যাইহোক, মেক্সিকোতে এমএন রায় জার্মান কূটনীতিকদের সহায়তায় ভারতের জন্য বিপ্লবী কার্যক্রম সংগঠিত করতে থাকেন। এমনকী, তিনি ভারতে ব্রিটিশ শাসনের সমালোচনা করে মেক্সিকান পাঠকদের লক্ষ্য করে একটি বইও প্রকাশ করেছিলেন। জার্মানির ইতিহাসবিদ মাইকেল গোয়েবেল তাঁর ২০১৪ সালের গবেষণায় লিখেছেন, 'জার্মানির সাথে ষড়যন্ত্রমূলক জোটের সাফল্যের সম্ভাবনা কম থাকায়, রায় উত্তর আমেরিকার বামপন্থীদের একটি দলের সঙ্গে সামাজিকীকরণ শুরু করেছিলেন, যাঁরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাধ্যতামূলক সামরিক পরিষেবা এড়াতে মেক্সিকোয় এসেছিলেন।'
আরও পড়ুন- পাকিস্তানের গুপ্তচর সংস্থার প্রেমের জালে পুনের ছাত্র, সাত বছরের কারাদণ্ডের নির্দেশ
প্রথম সাধারণ সম্পাদক
১৯১৭ সালে শুরু হওয়া বলশেভিক বিপ্লবের প্রভাবে, রায় আমেরিকান বামপন্থী এবং মেক্সিকান ইউনিয়নবাদী এবং নৈরাজ্যবাদীদের সঙ্গে ১৯১৭ সালের নভেম্বরে মেক্সিকান কমিউনিস্ট পার্টি (পিসিএম) প্রতিষ্ঠা করেন। কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক নেতা মিখাইল বোরোদিন এই সংগঠন গঠনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। আর, তাঁর সমর্থনে রায় নতুন সংগঠনের প্রথম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।