লশকর এবং হিজবুল মুজাহিদিনের উপর আন্তর্জাতিক নজরদারি থাকায় জৈশের পুনরুত্থান পাকিস্তানি রণকৌশল বলে মনে করছে পুলিশ। লশকর প্রতিষ্ঠাতা হাফিজ সঈদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকায় রয়েছে, তার মাথার দাম ১০ মিলিয়ন ডলার।
গত বছর পুলিশের নিজস্ব গোপন গোয়েন্দা রিপোর্টে বলা হয়েছে, “উপত্যকায় জৈশ মহম্মদের বাড়বৃদ্ধির একটা কারণ সম্ভবত লশকর এ তৈবা এবং তার প্রধানের ওপর ক্রমবর্ধমান আন্তর্জাতিক নজরদারি। ২০১৭ সালে বিশেষ করে লশকর এবং হিজবুল মুজাহিদিন এই দুই জঙ্গি সংগঠন যথেষ্ট ক্ষতির মুখে পড়েছে এবং তাদের বেশ কয়েকজন শীর্ষ স্থানীয় কম্যান্ডার মারা গেছে। পাকিস্তানের হ্যান্ডলাররা উপত্যকায় জৈশ ক্যাডারদের জাগিয়ে তুলতে শুরু করেছে, তাদের মূল উদ্দেশ্য হল উপত্যকায় আত্মঘাতী হামলা ঘটিয়ে নিরাপত্তারক্ষীদের পিছু হঠতে সাহায্য করা যাতে হিজবুল এবং লশকর এ তৈবা কিছুটা হাঁফ ছাড়ার অবকাশ পায়।”
আরও পড়ুন, মাসুদ আজহারকে সন্ত্রাসবাদী ঘোষণা: পথের কাঁটা চিন
২০১৬ সালে, যে সময়ে কাশ্মীরে প্রতিবাদ আন্দোলন সংগঠিত হচ্ছিল এবং যার জেরে হিজবুল মুজাহিদিন কম্যান্ডার বুরহান ওয়ানি মারা যায়, সে সময়ে কুপওয়ারা এবং পুঞ্চ দিয়ে জৈশের দুটি গোষ্ঠী ভারতে প্রবেশ করে। নিরাপত্তাবাহিনীর দাবি, কাশ্মীরে জৈশের সেটাই পুনর্জন্ম। জৈশের ফের বাড়বৃদ্ধির পিছনে যার হাত সবচেয়ে বেশি রয়েছে বলে মনে করা হয়, সে হল উপত্যকার তিনফুটিয়া জঙ্গি নূর মহম্মদ তান্ত্রে ওরফে নূর ত্রালি।
২০১৮-র শেষাশেষি জৈশ কাশ্মীর সংঘর্ষে নতুন এক মাত্রা আমদানি করে- স্নাইপার হামলা। ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে নিরাপত্তা বাহিনী জৈশের একটি স্নাইপার স্কোয়াডকে নিশ্চিহ্ন করে। দেখা যায়, সে স্কোয়াডের কম্যান্ডার ছিল মাসুদ আজহারের এক ভাইপো, উসমান হায়দার।
পাকিস্তানের রাজনীতি-জঙ্গি সংযোগ নিয়ে গবেষণা করছেন অধ্যাপক সি ক্রিস্টিন ফেয়ার। তাঁর দাবি, জৈশকে যে পাকিস্তান নতন করে সাজাচ্ছে তার কারণ শুধু আঞ্চলিক কৌশলই নয়, এর পিছনে রয়েছে আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা কৌশলও।
জৈশ একটি দেওবন্দি ইসলামি সংগঠন। এদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে দেওবন্দি আফগান তালিবান, পাক তালিবান, শিয়া বিরোধী সকর এ জংভি এবং আল কায়েদার সঙ্গে।
২০০১ সালের শেষাশেষি জৈশের নেতৃত্বে ভাঙন ধরে। ইস্যু ছিল জেনারেল পারভেজ মুশারফের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তানের বশে থাকা হবে নাকি ৯-১১র হামলার পর আফগানিস্তানে তালিবানদের ওপর মার্কিন চাপের সঙ্গে জোট বাঁধা পাকিস্তানের ওপর প্রতিশোধ নেওয়া হবে। জৈশের কর্মী ও নিজের সহকর্মীদের চাপ উপেক্ষা করেই আইএসআই-কে তথ্য জোগান দেয় মাসুদ আজহার। এর মাধ্যমে পাকিস্তান সেনাকে সে নিজের দর বুঝিয়ে দেয় এবং একই সঙ্গে তার আনুগত্যের বার্তাও পৌঁছে দেয়।
মুশারফের সময়কালে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের জঙ্গি গোষ্ঠীগুলির মধ্যে টালমাটাল এবং ২০০৭ সালে তেহরিক এ-তালিবান-এ-পাকিস্তান সৃষ্টির পরে আইএসআই তাদের রণকৌশল নতুন করে সাজাতে শুরু করে।
ফেয়ারের দাবি, ২০১১ সাল নাগাদ বা তার কিছু আগে থেকেই, আজহারের নেতৃত্বে জৈশকে জাগিয়ে তুলতে থাকে আইএসআই।
২০১৪ সালে জনজাতি প্রবণ এলাকায় পাকিস্তানের যৌথবাহিনীর হামলা জর্ব-এ-অজব শুরুর আগে পাক সেনা টিটিপি (তেহরিক এ-তালিবান-এ-পাকিস্তান)র নজর সরানোর চেষ্টা করে। তারা চাইছিল টিটিপি পাকিস্তানের উপর হামলা না করে, হামলা চালাক ভারত বা আফগানিস্তানের উপর।
ফেয়ার লিখেছেন, জৈশ হল "পাকিস্তানের একটি কর্মসূচি। যে কর্মসূচির মাধ্যমে পাকিস্তান উন্মার্গগামী জঙ্গিদের নিয়ে আসতে চায় 'ভাল জঙ্গি' ছাতার নিচে।" একই সঙ্গে জৈশ ভারতের সঙ্গে ক্রমাগত যুদ্ধও চালিয়ে যাবে।
আরও পড়ুন, জৈশের যাত্রাপথ: সংসদ হামলা থেকে পুলওয়ামা
নয়াদিল্লি বারবার আজহারকে নিজেদের হাতে পেতে চাইলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও নিজস্ব কারণে মাসুদকে চাইছে। তার প্রধান কারণ হল আজহারের সঙ্গে শেখ ওমরের যোগাযোগ। শেখ ওমর কান্দাহার বিমান ছিনতাইয়ের পর মুক্ত হলেও এখন জেলে রয়েছে। মার্কিন সাংবাদিক ড্যানিয়েল পার্ল হত্যার ঘটনায় মৃত্যুদণ্ড হয়েছে ওমরের। ৯-১১ হামলার অর্থ জোগানের ব্যাপারে শেখের যোগসাজশ সম্পর্কে আরও তথ্য জোগাড় করতে চায় আমেরিকা।
এ ছাড়া আজহারের সঙ্গে আল কায়েদার যোগাযোগ কত দূর, তাও খতিয়ে দেখতে চায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ওসামা বিন লাদেনের এক প্রাক্তন দেহরক্ষী আবু জিন্দল, কান্দাহারে আজহারের মুক্তির পর আল কায়েদা প্রতিষ্ঠাতার বিলাসবহুল পার্টি দেওয়ার কথা বলেছে।
আজহারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কোনওরকম ব্যবস্থাগ্রহণ অবশ্য আটকে রেখেছে চিন। রাষ্ট্র সংঘ মাসুদ আজহারকে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী হিসেবে চিহ্নিত করতে পারছে না চিনের জন্য। পুলওয়ামা হামলার নিন্দা করলেও, মাসুদ আজহার সম্পর্কিত পূর্বতন সিদ্ধান্ত বদল করেনি তারা।