"ওদের রিসোত্তো থাকলে আমাদের ফ্যানা ভাত রয়েছে। কিন্তু সে নিয়ে আমরা মাতামাতি তো করিই না, এমনকি খাইও না খুব একটা।" এরকম একটা কথা সচরাচর শোনা যায় না। আর কোনও নামকরা শেফের মুখে এমন কথা শোনার প্রত্যাশাও কেউ করে না। কিন্তু প্রিয়ম চট্টোপাধ্যায় তো আর যে সে শেফ নন। ৩১ বছর বয়সী কলকাতার এই যুবক সকলের নজরে এসেছেন ফ্রান্সের সরকারি পুরস্কার পাবার পর।
প্রিয়মই প্রথম ভারতীয় হিসেবে এই পুরস্কার পাচ্ছেন। এই স্বীকৃতি দেখিয়ে দিচ্ছেে ভারতীয় শেফরা কীভাবে গোটা দুনিয়ার হৃদয় মন জয় করতে শুরু করেছেন। ভারতীয় খাদ্যকে নয়া দিশা দেখানোর জন্যই প্রিয়মকে সকলে চেনে। সম্ভব হলে প্রিয়ম সারা পৃথিবীকে বাঙালিদের চিরপ্রিয় ভেটকি মাছের পাতুরি কিংবা আলু পোস্তকে ভালবাসিয়েই ছাড়তেন। তবে তার সঙ্গে অবশ্যই মিশিয়ে দিতেন নিজের হাতের জাদু, একটু বদলেও দিতেন এসব ডিশকে।
দক্ষিণ কলকাতার ছেলে প্রিয়ম বড় হয়েছেন কালিম্পংয়ের পাহাড়ি বোর্ডিং স্কুলে। শেফ হবেন সে কথা কোনও দিনও ভাবেনই নি ছেলেবেলায়। "আমি সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে চেয়েছিলাম ভীষণভাবে। তবে কী জানেন, দারুণ সব রাঁধুনিদের পরিবারে জন্মেছি তো, আমার মনে হয় এ আমার রক্তে ছিল। চিরকাল আমার শিল্পের দিকে ঝোঁক, খাবাররের মধ্যে আমি নিজেকে প্রকাশের ভাষা খুঁজে পেয়েছি।"
কিন্তু ফরাসি খাবার কেন? "কারণ এই খাবার বানানোটাাই আমি প্রথমবার পেশাদারি ভাবে শিখেছিলাম।" প্রথম দিনই ফরাসি রান্নার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন প্রিয়ম। খ্যাতনামা শেফ জঁ ক্লদ ফুগিয়ের-এর তত্তবাবধানে পার্ক হায়াত হায়দরাবাদে শুরু হয় তাঁর ফরাসি অভিযান। প্রায় এক দশক ধরে চলেছিল সেই বিশ্বখাদ্য সম্ভারের সঙ্গে তাঁর যাত্রা। এর পর রূহ-তে বিশিষ্ট ভারতী শেফ সুজন সরকারের কাছ থেকে শেখেন আঞ্চলিক ভারতীয় রান্নার সঙ্গে আধুনিক রন্ধনপ্রণালীর যুগলবন্দি।
ভারতীয় খাদ্যের ব্যাপারে প্রিয়মের নিজস্ব ভাবনা রয়েছে। "মূল ব্যাপারটা হল স্বাদ এবং বিশ্বাসযোগ্যতা পুরোটা বজায় রেখে নতুন একটা প্রেক্ষিত রচনা, কৌতূহল আর উন্মাদনার একটা মিশ্রণ ঘটিয়ে দেওয়া। তাঁর বিশ্বাস ভারতীয় খাদ্যসম্ভার একদিকে বিশাল ও জটিল এবং নানারকম অভিজ্ঞতার ধারক।" তবে একই সঙ্গে তাঁর বিশ্বাস, একে উপরে তুলে ধরারও প্রয়োজন রয়েছে, একটা নতুন মানসিকতা নিয়ে ভারতীয় খাবার যে ভাবে দুনিয়া জুড়ে ব্রেড অ্যান্ড কারিতে পরিচিত, সে পরিচিতি পেরিয়ে যাবারও।
ইনস্টাগ্রামে তাঁর অ্যাকাউন্টের দিকে একবার তাকালেই বোঝা যাবে এই নয়া দৃষ্টিভঙ্গি বলতে কী বলতে চাইছেন প্রিয়ম চট্টোপাধ্যায়। বিখ্যাত স্ট্রিট ফুড দৌলত কি চাট-এ লাল-নীল-সাদার ফরাসি ছোঁয়ায় কিংবা পৃথিবী-প্রিয় ভিণ্ডালুতে ডোনাট দিয়ে তিনি শুধু স্বাদ কোরককে আবেদন জানিয়েই ক্ষান্ত হননি, তার দেখনদারিকেও ভিন্ন মাত্রা জুগিয়েছেন।
তাঁর অনুপ্রেরণা অনেক- "স্মৃতি, ইতিহাস, চিন্তা প্রক্রিয়া, প্রকৃতি, নস্টালজিয়া এবং আধুনিকতা।" কিন্তু কেউ যদি ভাল করে খেয়াল করেন, তাহলে পেইন্টিং বা সঙ্গীতের প্রতি তাঁর আকর্ষণই যে প্রিয়মের আসল অনুপ্রেরণা তা বুঝতে অসুবিধা হবে না। মকবুল ফিদা হোসেন, ক্লদ মনেট ও পাবলো পিকাসোর পেইন্টিংয়ের সঙ্গে তাঁর তৈরি ডিশের সাদৃশ্য এতটাই যে সোশাল মিডিয়ায় তাঁর ডিশ নিয়ে আলোচনার সিংহভাগ জুড়ে থাকে, "দেখতে এত ভাল যে খেয়ে নেওয়া যাচ্ছে না"।
পিকচার পারফেক্ট ডিশ কিংবা ফুড ফোটোগ্রাফিতে যে ইনস্টাগ্রাম এখন ছেয়ে গিয়েছে, তার বিরুদ্ধে কিছু কথা বলার রয়েছে প্রিয়মের। আমার কাছে সাজানোটা গৌণ। সাজানো ব্যাপারটা আমার কাছে খুব স্বাভাবিক ভাবে আসে। সবাইকে একটা জিনিস বুঝতে হবে, যে কখন থামতে হয়। সে রান্নাই হোক বা সাজানোই হোক, একটা ফোঁটাও কিন্তু গোটা ব্যাপারটা শেষ করে দিতে পারে।
খ্যাতির চূড়ায় পৌঁছে গেছেন বটে কিন্তু এখনও মায়ের হাতের রান্না সামান্য পাঁঠার ঝোল আর ভাতই প্রিয়মকে খুশি করে দিতে পারে। কিংবা ফাঁকা সময়ে ড্রাম পেটানো।
প্রিয়ম নিজে বিশ্বাস করেন, সবে শুরু করেছেন তিনি। নিজের লক্ষ্য সম্পর্কে তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আনেত নামের একটা রেস্তরাঁ খুলবেন। একজন ইতিবাচক মনোভাবাপন্ন ইনভেস্টর খুঁজছেন, যাঁর দূরদৃষ্টি রয়েছে। ব্যাস তাহলেই কেল্লা ফতে। তবে নিজের প্রিয়জনদের কথা একবারও ভুলছেন না। "এই পরিবারের কাছেই ফিরে আসতে চাই।"
Read the Full Story in English