একটাই আকুতি, "একবার বাড়িতে ঢুকতে দিন, ছেলের দরকারি ডকুমেন্টগুলো নিয়ে নিই, ওর আজ চাকরির ইন্টারভিউ আছে।" তবে প্রৌঢ় যতই অনুরোধ করুন, নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে তাঁর অনুরোধে কর্ণপাত করছেন না কর্তব্যরত পুলিশকর্মীরা। অনন্তবাবু একা নন, তাঁর মতোই ১৮ টি বাড়ির একাধিক মানুষ এসে জড়ো হয়েছেন কন্ট্রোল রুম ও ভাঙা বাড়ির ব্যারিকেডের সামনে। "হোটেলে খাবার ভালো দিচ্ছে না। ওদের কী দায় পড়েছে? আমরা গিয়ে উঠেছি বলে হোটেল ব্যবসায় সমস্যা হচ্ছে। এরমধ্যেই দুদিন কোনও রকমে কাটিয়েছি। বাচ্চাদের নিয়েও সমস্যা হচ্ছে। টাকা পয়সাও নেই কাছে যে কিছু কিনে খাব," কন্ট্রোল রুমের সামনে দাড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে অভিযোগ জানালেন বিদিশা দেবী।
ঘটনাস্থল, খোদ কলকাতার বৌবাজারের দুর্গা পিথুরি লেন। ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো রেলের কাজের জন্য যে চত্বরে শনিবার বিকালে হঠাৎ ভেঙে পড়েছে বেশ কয়েকটি পুরনো বাড়ি। আর এরপরই প্রশাসনের তরফে সংশ্লিষ্ট বাড়িগুলির বাসিন্দাদের কার্যত একবস্ত্রে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে নিকটবর্তী হোটেল বা লজে।
গত দু-রাত চোখের পাতা এক করতে পারেন নি বৌবাজারের এই বাসিন্দারা। কেবল কানে বাজছে একটাই কথা, মেরামতি করা সম্ভব না হলে, বাড়ি ভেঙে মাঠ করে দেবে মেট্রোর লোকজন। আর তাই যদি হয়, তবে হারাতে হবে প্রায় ২০০ বছেরের পুরানো পৈতৃক ভিটে। কর্তৃপক্ষের এমন ঘোষণা শুনে ভেঙে পড়েছেন দুর্গা পিথুরি লেনের অধিকাংশ বাসিন্দাই। কারও কাছেই টাকা-পয়সা, জামাকাপড় কিছুই নেই। যাঁর যা সম্বল, সেগুলি যে বসত বাড়িতেই। তাই দিনের আলো ফুটতেই কন্ট্রোল রুমের কাছে এসে হত্যে দিয়ে বসে থাকছেন অনেকে, যদি পুলিশ একবার ঘরে ঢোকার অনুমতি দেয়। সোমবার সকাল থেকে গোটা এলাকা জুড়ে চোখে পড়ল এমনই অনিশ্চয়তার দৃশ্য। সোনাপট্টি বৌবাজারে সপ্তাহের প্রথম দিন বন্ধ রয়েছে ল্যান্ডমার্ক অলঙ্কারের দোকানগুলিও।
দুর্গা পিথুরি লেন এখন জনমানবহীন। এমনটা যে ঘটতে পারে তা কি আন্দাজ করতে পারেন নি মেট্রো আধিকারিকরা, এই প্রশ্নটাই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে ওই এলাকায়। কারণ দুর্গা পিথুরি লেন শুধু নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বৌ বাজার এলাকার একাধিক চত্বর।
এই মুহূর্তে বাড়ি ভেঙে পড়ার আতঙ্কে ভুগছেন দুর্গা পিথুরি লেন লাগোয়া গৌর দে লেনের বাসিন্দারাও। চার নম্বর বাড়ির পূর্ণিমা দে বলেন, "বেশ কিছুদিন আগে মেট্রো ও আইটিটি সিমেন্টের আধিকারিকরা এসে নোটিশ ধরিয়ে দিয়ে বলেন, ২১ আগস্ট বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে। চাবি আমাদের দিয়ে যান। মেট্রোর টানেল তৈরি হবে এই এলাকারর নীচে। নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখেই আপনাদের বাড়ি ছাড়ার কথা বলা হচ্ছে। সেই মতো আমরা বাড়ি ছেড়েও দিই।
"গৌর দে লেনের একাধিক বাড়িতেই এই নোটিস দেওয়া হয়েছিল। ২৩ অগাস্ট ফিরে এসে দেখি, বাড়ির মধ্যে লোহার বিম দিয়ে বাড়ির কাঠামো ধরে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। সারা বাড়ি জুড়ে একাধিক জায়গায় রয়েছে ফাটল। এখনও সেই অবস্থাতেই রয়েছে বাড়ি। শনিবার যখন আবার কেঁপে ওঠে এলাকা, তখন চাঙড় ভেঙে পড়তে থাকে।" পূর্ণিমা দেবী আরও বলেন, "শনিবারের ঘটনার জন্য আমাদের বাড়ি ছাড়তে বলা হয়নি। একেই এত পুরনো বাড়ি, তার উপর ভিত নড়ে গেছে, না জানি কবে ভেঙে পড়বে মাথার উপর।"
এদিকে ঘণ্টায় ঘণ্টায় দেখা দিচ্ছে ফাটল। গৌর দে লেনে শুভল সাহার বাড়ির উপর কাত হয়ে পড়েছে বাদল মন্ডলের বাড়ি। কিন্ত এই এলাকা খালি করার জন্য এখনও কোনও নির্দেশ আসেনি মেট্রোর তরফে। তাই বাড়ি ছাড়েন নি বাসিন্দারা। গৌর দে লেনের ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ির বাসিন্দাদের এখনও কোথাও থাকার বন্দোবস্তও করে দেন নি কর্তৃপক্ষ বা প্রশাসন। ফলে রাস্তায় দিন কাটাচ্ছেন শুভল সাহা ও তাঁর পরিবার।
মেট্রোর এক আধিকারিক বলেন, "বহু পুরনো জীর্ণ বাড়িগুলি পার করে ভালমতোই মেট্রোর কাজ চালাচ্ছিল কেএমআরসিএল। হাওড়া ময়দান থেকে শিয়ালদা যাওয়ার পথে গঙ্গার নীচ দিয়ে কলকাতায় আসার পরই প্রথমে স্ট্র্যান্ড রোডে ওঠে সুড়ঙ্গ। সেখান থেকে রাইটার্স বিল্ডিং পেরিয়ে এসপ্ল্যানেড থেকে শিয়ালদহ যাওয়ার পূর্ব পশ্চিম কানেকটারের মধ্যেই ঘটে যায় বিপত্তি"।
তিনি আরও বলেন, "হিন্দ সিনেমা পার করে যখন দুর্গা পিথুরি লেন, স্যাকরাপাড়া লেনে পৌঁছয় সুড়ঙ্গ, তখনই ঘটে যায় বিপত্তি। সুড়ঙ্গ কাটার কাজ চলছিল। এমন সময় মাটির নীচে জমে থাকা জলে হঠাৎ চলে আসে সুড়ঙ্গের মধ্যে। এর ফলেই মাটি আলগা হয়ে যায় এবং রাতারতি দুর্গা পিথুরি লেনের মধ্যভাগের মাটি বসে যায়। ভেঙে পড়ে তিন চারটি বাড়ি।"