তিন তলার ছাদের ওপর জামা-কাপড় শুকোতে দেওয়া রয়েছে, এ দৃশ্য বদলানোর নয়। বুধবারও তা যেমন ছিল তেমনই রয়েছে। সেই জামাকাপড় ঘরে তোলার কেউ নেই। খোলা জানলার কপাট বন্ধ করাও হয়নি। কোনওরকমে দরজায় তালা ঝোলানো। গৌর দে লেনের বাসিন্দারা ছাদে উঠে তাকিয়ে রয়েছেন স্যাকরাপাড়ার দিকে। চাক্ষুষ করছেন অট্টালিকার ধ্বংসলীলা। আতঙ্কে রবিবার রাত থেকে ঘুমোননি মন্টু শেখ। পাশের বাড়ির ছাদে উঠে শুধু এদিক-ওদিক নজর রাখছেন। বৌবাজারের একটা অংশ যেন ক্রমশ ভূতুড়ে পল্লীর রূপ নিচ্ছে।
স্যাকরাপাড়া, দুর্গা পিথুরি লেন তিনদিনের মধ্যেই যেন অন্য গ্রহে অবস্থান করছে। কলকাতা শহরে মেট্রোর সুড়ঙ্গ খুঁড়তে গিয়ে ঘরছাড়া হতে হয়েছে কয়েকশো মানুষকে। সেইসব বাড়ি ও গলি-তস্যগলি এখন জনমানবশূন্য। মানুষের যাতায়াতেও নিষেধ রয়েছে। ট্যাপে পুরসভার জল নেই, মানুষের অস্তিত্বহীন হয়ে উঠেছে এই সব এলাকা। আর রাত হলে নিকষ কালো অন্ধকার, ঘুটঘুটে অবস্থা। কলকাতার মধ্যে ছোট্ট এই জনপদ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে মূল জনজীবন থেকে। এবং সেই বিচ্ছিন্নতার পরিধি যেন আরও বাড়ছে।
আরও পড়ুন: বৌবাজারে ক্ষতিগ্রস্তদের বাড়ির বদলে বাড়ি, পরিবার পিছু পাঁচ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ ঘোষণা মমতার
বৌবাজারের রাজেশ রায় সারাক্ষণ সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠছেন আর নামছেন। রাজেশদের চারতলার ছাদ থেকে পাশের বাড়ির ছাদে পৌঁছনো গেল। সেখান থেকে স্যাকরাপাড়ার দিকে তাকালেই মনে হবে সব বাড়িই যেন হেলে গিয়েছে। দু-একটা বাড়ি ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। আরও কয়েকটা বাড়ি যেন সেই পথেই এগোচ্ছে। রাজেশ বলেন, "রবিবার থেকে আতঙ্কে দিন কাটছে। পাশের বাড়ি আর পাশের পাড়ার বাড়ি দেখেই সময় কেটে যাচ্ছে। এ যেন ভূতুড়ে অবস্থা।"
আরও পড়ুন: বৌবাজারকাণ্ডের জের, ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর কাজে অবিলম্বে নিষেধাজ্ঞা হাইকোর্টের
মন্টু শেখ আদতে কালনার বাঘনার বাসিন্দা। থাকেন গৌরী দে লেনে। তিনি সারাক্ষণ পর্যবেক্ষণ করছেন। মন্টুবাবু বলেন, "অজানা আতঙ্কে দিন কাটছে। রবিবার থেকে চোখের পাতা পড়েনি। আশপাশের বাড়ির হাল দেখে মনে হচ্ছে কলকাতার কোথায় আছি? যেখানে মানুষের কোলাহল ছাড়া কিছু ছিল না, সন্ধে হতেই অন্য জগত মনে হচ্ছে। এ এক অন্য কলকাতা।"
মেট্রোর সুড়ঙ্গ করতে গিয়ে হিদারাম স্ট্রিট, স্যাকরা পাড়া, গৌর দে লেন, দুর্গা পিথুরি লেন যেন সত্যিই অন্য এক কলকাতার রূপ নিয়েছে। গলির রাস্তায় ঢোকার মুখে পুলিশের ব্যারিকেড। মেট্রো রেলের ইঞ্জিনিয়রদের আনাগোনা, পুলিশের প্রহরা। যার সঙ্গে দৈনন্দিন কলকাতার অন্যান্য অংশের কোনও মিল নেই। স্যাকরা পাড়ার গলিতে রক্তদান শিবিরের প্যান্ডেল হয়েছিল। সেই প্যান্ডেলের বাঁশ এখনও খোলা হয়নি। দিনের বেলা যেমন তেমন, কিন্তু সন্ধের পর এই এলাকার রূপের আমূল বদল ঘটে যাচ্ছে।