বিশ্বের সব থেকে পুরনো শহরের মধ্যে অন্যতম কলকাতা। উত্তর কলকাতার অলিতে গলিতে রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে রয়েছে ইতিহাস। অজস্র না জানা কাহিনী, গল্প। এসব অজানা কাহিনী ফুটে উঠেছে থানার দেওয়ালে! শুনতে অবাক লাগলেও এমনটায় সত্যি করে দেখিয়েছে বড়তলা থানা। খুব বিপদে না পড়লে কেউ থানায় যায় না। পুলিশ থেকে যতদূর পারা যায় দূরত্ব বজায় রেখে চলে আমজনতা। তবে হঠাৎ কেন এই উদ্যোগ? এর নেপথ্যে লাল বাজারের বড় একটি ভূমিকা থাকলেও, গোটা পরিকল্পনার মুখ্যভুমিকায় রয়েছেন বড়তলা থানার ওসি দেবাশিস দত্ত। থানা বলতেই যে ছবি উঠে আসে, তা হল স্যাঁতস্যাঁতে নোংরা দেওয়াল, তাতে পানের পিক। যত্রতত্র ছড়িয়ে থাকা নোংরা আবর্জনা। জনমানসে সেই ভাবমূর্তি বদলাতে উদাহরণ হয়ে উঠেছে এই থানা। থানায় গেলেই কেমন ভয় ভয় অনুভূতি হয়। কিন্তু থানার এই ছবিটা অন্যরকম। পাশেরই এক দোকানদার বলছিলেন, থানায় রিপোর্ট লেখাতে এসে হাসি মুখে ছবির সামনে দাঁড়িয়ে সেলফি তুলছেন। পুলিশ স্টেশনে এরকম দৃশ্য বিরল বলা যেতে পারে। বড়তলা থানাকে সহজেই গুলিয়ে ফেলা যাবে আর্ট গ্যালারি বা আর্ট মিউজিয়ামের সঙ্গে।
থানার প্রবেশ পথের দেওয়ালে আঁকা হয়েছে নাট্যকার গিরীশ ঘোষ ,সঙ্গীতকার রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের ছবি। কোথাও ফুটে উঠেছে একশো বছর আগে কলকাতা কেমন ছিল সেই ছবি। কোথাও পুরনো উত্তর কলকাতা, শোভাবাজার বা গঙ্গার ঘাটে নৌকার ছবি তুলে ধরা হয়েছে। থানায় ঢুকতে সেন্ট্রি যেখানে দাঁড়ান সেখানে স্বাধীনতার আগে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আমলে কেমন ছিল পুলিশের উর্দি, স্বাধীনতার পর কেমন হলো পুলিশের উর্দি। আর বর্তমানে কেমন পুলিশের উর্দি রয়েছে। সেরেস্তা লকআপে আসামি ঘরের বাইরে দেওয়ালে দিকে পুরনো কলকাতা ছবি আঁকা।
লকআপের পাশের দেওয়ালে বিরাট বটগাছের ছবি। কোথাও পালকির ছবি আবার কোথাও চড়ক মেলার ছবিও দেওয়ালে চমক বাড়িয়েছে। কেন নাম হল বটতলা থানা তার ইতিহাস ও তুলির টানে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। থানার অফিসারদের রুমের দেওয়ালে পুরনো হাওড়া স্টেশনের ছবি ফুটে উঠেছে। হাতে টানা রিক্সা, মিনার্ভা থিয়েটার, হলুদ ট্যাক্সি পুরনো কলকাতার একটুকরো অংশ থানার বাইরে দেওয়ালে পাঁচিলে পরিস্ফুটিত হয়েছে রঙ- তুলির টানে। থানার বাইরে পুরনো দিনের স্টাইলে বাতিস্তম্ভ স্থাপন করা হয়েছে।
সূত্রের খবর, বড়তলা থানা এই শহরের সব থেকে পুরনো থানাগুলোর মধ্যে অন্যতম। অনেক ইতিহাসের সাক্ষী। মানুষের মন থেকে থানা সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব দূর করার লক্ষ্যেই এরকম উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। শুধুমাত্র দেওয়াল চিত্র নয় এই থানায় আরও একটি আকর্ষণ চিলড্রেন রুম। যে সব শিশুরা বিপদে পরে তাঁদের উদ্ধার করে এখানে রাখা হয়। এই রুমে রয়েছে বিভিন্ন ধরণের বই, খেলনা আর দেওয়াল জুড়ে কার্টুন আঁকা। পুলিশেরই এক কর্তা বলছিলেন, বেশ কিছুদিন আগে দুটি কেস এসেছিল এক মুখ বধির শিশু হারিয়ে যায়। তাকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে আসা হয়। সেই বাচ্চাটিকে না কাঁদিয়ে তিন চার ঘণ্টা সহজেই খেলনা দিয়ে রেখে দেওয়া গিয়েছিল চিলড্রেন রুমটিতে। এরপরের আরেকটি ঘটনা রিপোর্ট লেখাতে এসে থানার দেওয়ালের ছবিগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে সকলে ছবি তুলছিলেন।
এরকম ছোট ছোট ঘটনাগুলো থেকে বোঝা যায় মানুষের ভালো লাগছে পুরো বিষয়টি। পুলিশ সম্পর্কে জনগণের মনে ভাবমূর্তি পরিবর্তন করেছে এই দেওয়ালের অঙ্গসজ্জা। আর থানার অন্দরসজ্জ্বার এই বদলে পাল্টে গেছে কর্মস্থলের পরিবেশ। তাই পুলিশকর্মীদের মনেও এসেছে বদল। ওসি দেবাশিস দত্তের মস্তিষ্কপ্রসূত চিন্তাভাবনাকে বাস্তবিক রূপ দিয়েছে সৌরভ ভট্টাচাৰ্য সহ আর্ট কলেজের তিন ছাত্র। তাঁদের দীর্ঘ দিনের প্রয়াসে এই থানার পলেস্তারা খসা ইট কাঠ পাথরের দেওয়ালকে আর্ট গ্যালারিতে রূপান্তরিত করেছে।
আদি কলকাতার ছবি, যানবাহন, জীবনযাত্রা, সংস্কৃতি সব মিলিয়ে এক গৌরবের ঐতিহ্যকে বর্তমানের সামনে এনে উপস্থিত করেছে বড়তলা থানা। ১৮৮৮ ব্রিটিশ আমলে তৈরি এই পুলিশ স্টেশন। অতীত গৌরবের এই উপাখ্যানগুলো তুলে ধরার অন্যতম মাধ্যম থানাগুলো। বড়তলা থানার এমন কর্মকাণ্ড উদাহরণ হিসেবে দেখছে শহরের অন্যান্য থানাগুলো। কলকাতার পুরনো থানাগুলোর যে ইতিহাস তা যে ছবির মাধ্যমে এভাবে ফুটিয়ে তোলা যায় তা বড়তলা থানাকে না দেখলে বিশ্বাস করা যেত না।