একটা নাম করোনা, আর এতেই জীবনের সব হিসেব যেন উলটপালট। ২৬ এপ্রিল মুচিপাড়ার বাসিন্দা বছর তেত্রিশের যুবকের জীবনে একপ্রকার ঝড় বইয়ে দিয়েছে করোনা। শুধু তাই নয় কেড়ে নিয়েছে তাঁর মাকে। এমনকী জন্মদাত্রীকে শেষ দেখা দেখতে যে দেয়নি সে হল তা করোনা। শোকস্তব্ধ ছেলের মনে সেই হাহাকার যে জাগিয়ে রেখেছে সে এই করোনা।
লকডাউনের দ্বিতীয় পর্যায় চলার সময় ২৪ এপিল হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়েন ছেলেটির মা। ছেলে পেশায় শিক্ষক। দীর্ঘদিন ফুসফুসের সমস্যা নিয়ে থাকা মা অসুস্থ হয়ে পড়লে হাসপাতালে ভর্তি করতে ঝক্কিও পোহাতে হয়েছে অনেকটাই। কিন্তু অবশেষে সেই খবর এল কানে। চিকিৎসকেরা জানালেন তাঁর মা করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত। এনআরএসের আইসোলেশন ওয়ার্ডে স্থানান্তরিত করা হয়েছে তাঁর মাকে। নিয়মানুসারে পরিবারের কেউই দেখা করতে পারবেন না রোগীর সঙ্গে। ছেলে তখনও বোঝেননি সেদিনই তিনি চিরজীবনের মতো 'আইসোলেটেড' হয়ে গেলেন তাঁর মায়ের কাছ থেকে।
নাম প্রকাশে রাজি হলেন না ছেলে। কথা বলে গেলেন শোকস্তব্ধ গলাতেই। "হাসপাতালে ভর্তি করার পর থেকে একবারের জন্যও মাকে দেখতে পারিনি। এমনই শেষযাত্রাতেও থাকতে দেওয়া হল না আমাদের।" মায়ের মৃত্যুর পর মায়ের স্বাস্থ্যের খোঁজ নিতে বারবার ফোন করেছে স্বাস্থ্য দফতর, সেকথাও জানালেন অভিমানী ছেলে।
ঠিক কী হয়েছিল ২৪ এপ্রিল? ছেলে বলেন, "মা'র শ্বাসকষ্টের সমস্যা ছিলই। আমাদের বাড়িতেই নেবুলাইজার এবং বিপ্যাপ (শ্বাস নেওয়ার ইলেক্ট্রনিক মেশিন) ছিল। কিন্তু যখন দেখি তাতে কাজ হচ্ছে না তখনই জিডি হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখানকার কর্তৃপক্ষ আমাদের বাঙ্গুর হাসপাতালে রেফার করে। আমরা সে রাত্রে বাড়ি চলে আসি। পরের দিন মায়ের অক্সিজেন লেভেল কমতে থাকে। অ্যাম্বুলেন্সে ফোন করি। কিন্তু বিকেল অবধি কিচ্ছু পাইনি। অবশেষে এক বন্ধুর সাহায্য পেয়ে মাকে এনআরএস-এ নিয়ে যাই।"
তবে নিজেদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেই এই মর্মে সত্তোর্ধ্ব মহিলাকে বাঙ্গুর হাসপাতালেই রেফার করে এনআরএস। ছেলে বলেন, "সেখানে যখন নিয়ে যাই ডাক্তার বলেন তাঁদের যথেষ্ট ব্যবস্থা এবং ওষুধ নেই। তিনি আবার এনআরএস-এ ফিরিয়ে নিয়ে যেতে বলেন, কারণ তিনি আশংকা করেছিলেন যে মায়ের করোনা হয়েছে।" যদিও এই বিষয়ে এম আর বাঙ্গুর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাঁরা কোনওরকম উত্তর দেননি।
এদিকে এনআরএসেও সেই অবস্থা। ছেলে বলেন, "এনআরএস হাসপাতালে মাকে বেডে নিয়ে যেতে কেউ সাহায্য করতে এগিয়ে আসল না। সব আমরাই করলাম। পরের দিন অর্থাৎ ২৫ এপ্রিল হাসপাতাল থেকে বলা হল মায়ের আধার কার্ড নিয়ে যেতে কারণ কোভিড টেস্ট হবে। ২৮ এপ্রিল রিপোর্ট পজিটিভ আসে স্বাস্থ্য দফতরের কাছ থেকে। এমনকী আমাদেরও বলা হয় ১৪ দিনের হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকতে। আমাদেরও স্বাস্থ্য পরীক্ষা হবে তা বলা হয়। কিন্তু এখনও কেউ আসেননি।"
ছেলের অবশ্য দাবি "মা অসুস্থ হওয়ার পর বাড়ির বাইরে পা রাখেননি। হাসপাতাল থেকেই মায়ের দেহে করোনা সংক্রমণ হয়েছে। ২৯ তারিখ কলকাতা পুরসভা থেকে জানান হয় যে মায়ের সৎকার হয়ে গেছে।" তবে মায়ের মৃত্যুর সার্টিফিকেট এখনও হাতে পাননি ছেলে। হাসপাতাল থেকেও দেওয়া হয়নি প্রয়োজনীয় কাগজপত্র। শেষ দেখা দেখতে পারেননি মা-কে। সৎকারও হয়েছে অলক্ষ্যে। মায়ের মৃত্যুর পর যখন স্মৃতিকে তলিয়ে ভাবছেন দোষ কার করোনার, অদৃষ্টের না নিয়মের বেড়াজালের? তখনই স্বাস্থ্য দফতর থেকে ছেলের কাছে একটা ফোন এল, "আপনার মা কেমন আছেন?"
Read the full story in English
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন