Kolkata Police: ১৮ এবং ১৯ শতকের কলকাতায় ‘সাহেব চোর’দের দাপটের কাহিনি, লোকের মুখে মুখে ফিরত। আজও ইতিহাস সেসবের সাক্ষী দেয়। দুই ধুরন্ধর সাহেব চোর, ওয়ার্নার এবং হিলির ‘কীর্তি’ চোখ কপালে তুলেছিল দুঁদে গোয়েন্দাদেরও। প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় নামে এক তরুণ বাঙালি পুলিশ অফিসার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন ওয়ার্নার-হিলির গ্রেফতারে। সেই প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়, যিনি কিংবদন্তি হয়ে উঠেছিলেন ‘দারোগার দপ্তর’ বইটি লেখার সুবাদে।
প্রিয়নাথ পুলিশে সাফল্যের সঙ্গে কাজ করেছিলেন প্রায় ৩৩ বছর, ১৮৭৮-১৯১১ সাল পর্যন্ত। ইউরোপীয় না-হয়েও ডিপার্টমেন্টে যতদূর ওঠা যায়, উঠেছিলেন। যার স্বীকৃতিস্বরূপ কর্মজীবনের শেষে ভূষিত হন ‘রায়বাহাদুর’ উপাধিতে। রহস্য সমাধানে অত্যন্ত পারদর্শী প্রিয়নাথকে বাস্তবের পুলিশি তদন্তভিত্তিক আখ্যানের ক্ষেত্রেও অন্যতম পথিকৃৎ হিসেবে গণ্য করা হয়।
প্রিয়নাথ কীভাবে জড়িয়ে পড়লেন ওয়ার্নার-হিলির সঙ্গে? সে-ও এক বিরাট কাহিনি। ‘সিঙ্গার’ কোম্পানির ম্যানেজার পদে থাকাকালীন দোকানেরই টাকা-গয়না চুরির দায়ে চার বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিলেন ওয়ার্নার। কারাবাসের একবছর পরে, ১৮৮৮ সালের শেষাশেষি একই জেলে ঠাঁই হয়েছিল হিলির।
মাত্র সাত মাসের মধ্যে, ১৮৮৯-র মার্চে, জেল থেকে পালান ওয়ার্নার-হিলি। একটা পুরনো কুঠার জোগাড় করে বিস্তর চেষ্টায় তা দিয়ে নিজেদের হাতকড়া-মুক্ত করা এবং নিজেদের কারাকুঠুরির খাট ব্যবহার করে রাতের অন্ধকারে জেলের পাঁচিল টপকে পগারপার হওয়া। সেসময়ে এই দুই সাহেব চোরের জেল পালানো রীতিমতো সরগরম করে তুলেছিল গোটা কলকাতাকে। জেল থেকে বেরিয়েই অবশ্য শহর ছেড়েছিল দুই সাহেব চোর, গিয়ে উঠেছিল সোজা বর্ধমানে। যথারীতি দুই পলাতক আসামির খোঁজে আদাজল খেয়ে নামে পুলিশের বিশেষ দল। যে দলে জায়গা পান প্রিয়নাথ। তিনি ‘দারোগার দপ্তর’-এ বিস্তারিত লিখে গেছেন সেই অভিযানের কথা, ‘ইংরেজ ডাকাত’ শিরোনামে।
একদিকে ওয়ার্নারের সুভদ্র মুখমণ্ডল এবং পরিশীলিত ব্যবহার, অন্যদিকে হিলির সুগঠিত বিশালাকায় চেহারা, দুইয়ে মিলে মোক্ষম দাঁড়িয়েছিল যুগলবন্দিটা। সরকারি অফিসার পরিচয়ে এ গ্রাম থেকে সে গ্রামে, ও জেলা থেকে সে জেলায় লাগাতার পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন দু'জনে। একই যাত্রাপথে পুলিশও ছুটে চলেছিল পিছু পিছু। খুব কাছাকাছি এসেও পুলিশের হাত থেকে বারবার ফসকে যাচ্ছিল দুই পলাতক। যেন তীরে এসে তরী ডুবে যাচ্ছিল।
তীব্র দাবদাহে একটা সময় রণে ভঙ্গ দেন পদস্থ ইংরেজ আধিকারিকরা। প্রিয়নাথ অবশ্য হাল ছাড়ার বান্দা ছিলেন না। সাকুল্যে দু’জন কনস্টেবল নিয়ে নিরস্ত্র অবস্থায় দুই ফেরার আসামির খোঁজে অভিযান জারি রাখেন। বেশ কয়েকদিনের প্রাণপাত পরিশ্রমের ফল মিলল অবশেষে, বাঁকুড়ার শুশুনিয়া পাহাড়ের কাছে এক ডেরায় সন্ধান মেলে ওয়ার্নার-হিলির।
প্রিয়নাথ কাছাকাছি এসে চিৎকার করে জানান দেন নিজের উপস্থিতির। জানতেন, ফাঁকা আওয়াজ দিচ্ছেন, কিন্তু এ ছাড়া উপায়ও ছিল না কোনও। তারস্বরে ঘোষণা করলেন, দু’জনের কেউ পালানোর চেষ্টা করলে খুলি উড়িয়ে দেবেন। ঝুঁকিটা খেটে যায়। ওয়ার্নার আত্মসমর্পণ করে বিনা প্রতিরোধে। শারীরিক ভাবে প্রবল শক্তিশালী হিলি অবশ্য যথেষ্ট লড়াই দিয়েছিল। কিন্তু, প্রিয়নাথ ও তাঁর সঙ্গীরা শেষ পর্যন্ত কাবু করে ফেলেন হিলিকে। তুমুল ধস্তাধস্তি আর টানাটানিতে নাক ফাটে প্রিয়নাথের।
মজার কথা, এই হিলিই কিন্তু পরে পঞ্চমুখ হয়েছিলেন প্রিয়নাথের প্রশংসায়। সমসাময়িক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে প্রকাশ, প্রিয়নাথের সাহস এবং গ্রেফতার-পরবর্তী পর্যায়ে দুই বন্দির প্রতি তাঁর সহৃদয় ব্যবহার, দুইয়েরই ঢালাও তারিফ করেছিলেন হিলি। প্রিয়নাথকে অভিহিত করেছিলেন তাঁর দেখা সবচেয়ে সাহসী ‘নেটিভ’ হিসেবে। প্রিয়নাথ শেষমেশ যখন দুই বন্দিকে নিয়ে বর্ধমান স্টেশনে পৌঁছন, জেলার পুলিশ সুপার তো একরকম স্তম্ভিত! এই ছোটখাটো চেহারার বাঙালি, নিরস্ত্র অবস্থায় কাবু করে ফেলেছেন দৈত্যাকার চেহারার এক ইউরোপীয় অপরাধীকে, যে কিনা আবার প্রাক্তন সৈনিক!
আরও পড়ুন- যেন বাজপাখি! সাইবার অপরাধ দমনে সচেতনতা বাড়াতে শহরজুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে CYBUZZ
অসাধ্য সাধনের স্বীকৃতি হিসেবে পুলিশ সুপার কলকাতায় ফেরার যাত্রাপথে প্রিয়নাথের সঙ্গে সাত জন সশস্ত্র পুলিশ মোতায়েন করেন। কলকাতায় ফেরার পর একটা হিসেব কষা হয়। জানা যায়, ঠিক কতটা পথ প্রিয়নাথ ও তাঁর দুই সঙ্গী কনস্টেবল হেঁটেছিলেন ফেরার ওয়ার্নার-হিলির খোঁজে। শুনলে স্তম্ভিত হবেন, পরিমাণটা ছিল ৩০০ কিলোমিটার!