বাঘাযতীনে ক্ষিদের সময় ভরসা ক্ষুদিরাম 'ভগবান'

"ওঁরা আমার পা জড়িয়ে কাঁদে মাঝে মাঝে। ওঁদের মুখে একটু খাবার তুলে দিয়ে যে স্বস্তি পাই, তা দেখে আমার নিজেরই পেট ভরে যায়"।

"ওঁরা আমার পা জড়িয়ে কাঁদে মাঝে মাঝে। ওঁদের মুখে একটু খাবার তুলে দিয়ে যে স্বস্তি পাই, তা দেখে আমার নিজেরই পেট ভরে যায়"।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

দুপুর গড়ালেই ওঁদের ক্ষিদেতে পেট জ্বলে। চারপাশে কেউ নেই যে দু'মুঠো খাবার মুখের সামনে ধরবে। ভিক্ষার ঝুলিতে কয়েক টাকা রয়েছে ঠিকই, কিন্তু দোকান? লকডাউনে সবই তো বন্ধ। ওঁরা অবশ্য অত কঠিন শব্দ বোঝেন না। পুরসভার কলে জলের সময় শেষ, তাই জল খেয়ে ক্ষুন্নিবৃত্তি করারও উপায় নেই। পুষ্টিহীন কঙ্কালসার শরীরকে গিলে খাচ্ছে ক্লান্তি। এদিকে ক্ষিদে সহ্য করে আরও বেশ কিছুটা সময় কাটাতে হবে।

Advertisment

কেউ কোথাও নেই। খাঁ খাঁ করছে স্টেশন চত্বর। করোনা তাড়া করে বেড়াচ্ছে জনজীবনকে। কিন্তু ভবঘুরে ভিখারিরা কী করবেন? কোথায় লুকোবেন? ছাদ নেই, খাবার নেই। শুধু পেটের জ্বালা আছে। এমন সময় স্টেশনে উদয় হলেন 'ভগবান'। নাম ক্ষুদিরাম সর্দার। স্টেশনে বসে থাকা ওই ভবঘুরেদের কাছে উনি ভগবানের চেয়েও বোধহয় বেশি কিছু। এক ডাকেই নাকি তাঁর সাড়া পাওয়া যায়। আর এই ভগবান নিজে হাতে ‘প্রসাদও’ দিয়ে যান।

কে এই ক্ষুদিরাম সর্দার?

তিনি তারকা, কোটিপতি, বা সমাজকর্মী, কোনোটাই নন। পরিচয় বলতে বাঘাযতীন রেল স্টেশনের দোকানগুলিতে জল দেন। স্টেশন চত্বরেই তাঁর অস্থায়ী বাড়ি। পরিবার বলতে ১৬ বছরের এক মেয়ে। সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। সেই তিনিই এখন দু’বেলা অন্ন তুলে দিচ্ছেন স্টেশনের এই হতদরিদ্রদের মুখে।

Advertisment

publive-image ভিখারিদের খেতে দিচ্ছেন ক্ষুদিরাম সর্দার 

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা-কে ক্ষুদিরামবাবু বলেন, "বড় সাধ ছিল, মেয়ের জন্মদিন পালন করব। তাই একটু একটু করে বেশ কিছু বছর ধরে টাকা জমিয়েছিলাম। লকডাউন জারি করার পর জল নিয়ে স্টেশনে কয়েকবার গিয়েছিলাম। কিন্তু লাভ হয়নি। দোকান বন্ধ ছিল। তাই জল বিক্রি হয়নি। এরপর রোজগার বন্ধ হয়ে গেল আমার। ফেরার পথে চোখ গেল স্টেশনে বসে থাকা ক্ষুধার্ত মানুষগুলোর দিকে। মনে হলো যেন আমার দিকে চাতক পাখির মত তাকিয়ে আছেন। স্টেশন থেকে বাড়ি ফিরলাম। কিন্তু মনটা বড় কাঁদছিল। বারবার মনে হচ্ছিল, ওই মানুষগুলো থাকবে কেমন করে? না খেয়ে মরে যাবে তো ওরা! ছোট বাচ্চাও আছে কয়েকজনের। কী হবে ওদের? এদিকে নিজের পকেটেও অত টাকার জোর নেই।"

এই অবস্থায় কিশোরী কন্যার পরামর্শ চাইলেন তিনি। মনের কথা মেয়েকে খুলে বলতেই সে বলে, "বাবা, আমার জন্মদিনের জন্য যে টাকা তুমি জমিয়েছিলে, ওই টাকা দিয়েই তুমি চাল কিনে আনো। ওঁদেরকে আমি-তুমি যেটুকু পারব খেতে দেব।"

publive-image কুকুরদের কথাও ভাবেন ক্ষুদিরাম সর্দার

তাই করলেন ক্ষুদিরামবাবু। এবং গত কয়েকদিন ধরে লকডাউনে এভাবেই জনা কুড়ি ভিখারির মুখে দু’মুঠো ভাত তুলে দিচ্ছেন ক্ষুদিরাম সর্দার। ‘ভগবানের ভক্ত’ তালিকায় রয়েছে গুটিকয়েক কুকুরও। ক্ষুদিরামবাবু বলেন, "ওঁরা আমার পা জড়িয়ে কাঁদেন মাঝেমাঝে। ওঁদের মুখে একটু খাবার তুলে দিয়ে যে স্বস্তি পাই, তা দেখেই আমার নিজের পেট ভরে যায়। এলাকার মানুষকে অনুরোধ করেছি আমাকে সাহায্য করার জন্য। যাতে আমি ওঁদের খাবার দিয়ে যেতে পারি। যা খেয়ে অন্তত বেঁচে থাকা যায়। মিছে কথা বলব না, দু-একজন আলু-মাছ দিয়ে সাহায্য করেছেন আমায়।"

ওই এলাকার এক প্রত্যক্ষদর্শী প্রহ্লাদবাবু বলেন, "ক্ষুদিরাম সর্দারকে ওই ভবঘুরেরা ভগবান মনে করেন। ওঁর পথ চেয়ে বসে থাকেন সকলে। ক্ষুদিরামবাবুর স্টেশনে আসার সময় হলেই ওঁরা যে যার জায়গায় বসে পড়েন।"

ক্ষুদিরামবাবু বলেন, "অনেকদিন ধরেই আমি বাঘাযতীন স্টেশনে জল দিই। তাই মানুষগুলো পরিচিত আমার। এই দুর্দিনে ওদের কথা কেউ ভাবেনি। যেটুকু সাধ্য হয়েছে, করছি। আগামী দিনেও করার চেষ্টা করব, যদি সকলের সাহায্য পাই।"

corona Lockdown corona virus