ব্যারিস্টার বাবুর বাড়ির অনেক স্মৃতি আছে শহর কলকাতায়। কিন্তু, এই বাড়ি কলকাতার বুকে স্মৃতি নয়, বর্তমান হয়ে বেঁচে থাকতে চায়। শহরের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় দাঁড়িয়ে আছে বিশাল আকারের এই বাড়িটি। যার সুন্দর আনুপাতিক, স্ল্যাটেড-জানালাযুক্ত ঘর, রঙিন কাচের বাহার দেখলে মনে হবে বন্ধ মুদিখানার দোকান ডেলিভারি অ্যাপের বিরুদ্ধে এক হেরে যাওয়া যুদ্ধ লড়ছে৷
লাল মেঝেওয়ালা উঠোন
যে লড়াইয়ের শরিক চার মহিলা — নন্দিতা বসু (৭৯), তাঁর একমাত্র মেয়ে কৃষ্ণকলি, নন্দিতাদেবীর দেখভালের দায়িত্বে থাকা মৈত্রেয়ী দাস ও রাঁধুনি ঝর্ণা দাস। যাঁরা শহর কলকাতার কেন্দ্রে এই সুন্দর বাড়িটিই রক্ষা করছেন না। উঠোন এবং লাল মেঝেওয়ালা শহর কলকাতার ফেলে আসা জীবনযাত্রার এক নিদর্শনকেও বাঁচিয়ে রেখেছেন।
১৮৫৫ সালে, নন্দিতাদেবীর শ্বশুর ব্যবসায়ী চণ্ডী বসু যখন বেলেঘাটায় একটি বাড়ি তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তখন বর্তমানে এই কোলাহলপূর্ণ উত্তর কলকাতার পাড়ায় লোকজন বিশেষ ছিল না। কিন্তু তারপরও চণ্ডী বসু, তাঁর মাছের ব্যবসার জন্য পূর্ব কলকাতার জলাভূমির কাছে তাঁর বাড়ি বানাতে চেয়েছিলেন। তিনি সেই ব্যবসাকে কর্পোরেটের পর্যায়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। নন্দিতাদেবীর কথায়, 'আমি যখন ১৯৬৫ সালে এই বাড়িতে পুত্রবধূ হয়ে আসি, তখনও আমাদের মাছের ব্যবসা রীতিমতো জমজমাট ছিল। সেটা ছিল সিপিএমের যুগ। ব্যবসা ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে গেল।'
এই বাড়িকে সবাই চেনে ব্যারিস্টার বাবুর বাড়ি নামে। এককথায় সুসজ্জিত, বিশাল আয়তনের এক কাঠামো। অর্ধশতাব্দী আগে, নন্দিতাদেবীর শ্বশুর ব্যারিস্টার বসু, বাড়ির নীচতলায় অফিসে বসতেন। সেই থেকে এই বাড়ির এমন নাম। এর প্রবেশদ্বারে ইউরোপীয় স্থাপত্যের প্রভাব আছে। ঠাকুরদালান, পিলার, বারান্দা, লাল অক্সাইডের মেঝে, বাইরের এবং ভিতরের উঠোনের মধ্যে পাথরের কাজের পার্থক্য- যেন এক ছিমছাম মেজাজের চিহ্ন বয়ে চলেছে।
আরও পড়ুন- প্রিয়াঙ্কাকে নিয়োগের সময় বেঁধে দিলেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়, বাড়ির কাছেই পাবেন চাকরি
বাড়ি তো নয়, যেন আস্ত প্রতিষ্ঠান
এই বাড়ি ১৮০০ শতকের শেষদিকে কলকাতার অন্যতম বিখ্যাত দুর্গাপূজা আয়োজনের জন্য পরিচিত ছিল। নন্দিতা বললেন, 'আমি শুনেছি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু এখানে দুর্গাপুজোয় নিয়মিত আসতেন।'
এই বাড়ির দুর্গাপুজোর বিশেষত্ব হল, এটি পরিবারের মহিলারা আয়োজন করতেন। বাড়ির সদস্য বছর ৪৫-এর কৃষ্ণকলি এখন গুরগাঁওয়ের বাসিন্দা। তিনি বললেন, 'অন্যান্য পারিবারিক পুজো বাড়ির পুরুষরাই আয়োজন করত। কিন্তু, আমাদের বাড়ির পুজো আয়োজন করত মেয়েরা।' এই ধারাকে শক্তিশালী করেছেন কৃষ্ণকলির মা, এলাকার অন্যতম বিখ্যাত শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ নন্দিতা বসু।
করোনা আবহে, যখন গোটা শহর কলকাতা থেমে গিয়েছিল, তখনও ঐতিহ্য বজায় রেখেছিল এই বাড়ির পুজো। আর, তাঁরা আগামী দিনেও এই বাড়িকে বাঁচিয়ে রাখতে চান। ইতিমধ্যেই প্রোমোটারদের নজর পড়েছে এই বাড়িতে। তাঁরা বাড়িটি ভেঙে ফেলতে চায়। মুছে দিতে চায় একটি ঐতিহ্য। কিন্তু, প্রাণপণে তার বিরুদ্ধে লড়াই চালাচ্ছেন সকন্যা নন্দিতা দেবী ও তাঁর দুই সঙ্গী মৈত্রেয়ী ও ঝর্ণা। ২০১৭ সালে মারা গিয়েছেন নন্দিতাদেবীর স্বামী। তারপর থেকে এই লড়াই আরও কঠিন হয়েছে। কিন্তু, তবুও তাঁরা হার মানতে নারাজ। কারণ, এই বাড়ি শুধুমাত্র একটি বাড়ি নয়। এই বাড়ি একটি ঐতিহ্য। যা জড়িয়ে রয়েছে তাঁদের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে।
অবশেষে মিলেছে বাঁচানোর পথ
কীভাবে এই বিরাট বাড়িকে রক্ষা করবেন, সেই চিন্তায় যখন তাঁদের ঘুম আসা প্রায় বন্ধ হওয়ার জোগাড়, সেই সময়ই যেন আস্তে আস্তে এই বাড়িকে বাঁচানোর দরজা খুলে গেল। ইনস্টাগ্রামে এই বাড়ির ছবি দিয়েছিলেন কৃষ্ণকলি। সেখানে বলেছিলেন, এই বাড়িকে সিনেমার শুটিংয়ের জন্য ভাড়া দেবেন। ব্যস্! তারপরটা যেন ইতিহাস। এখানে ওয়েব সিরিজের শ্যুটিং হয়েছে। শহর কলকাতার বুকে এমন পুরোনো বাড়ির সন্ধানেই যেন ছিলেন পরিচালকরা। আসা শুরু হয়েছে একের পর এক বুকিং। যেন, ঐতিহ্য নিজেই খুঁজে দিল তাকে বাঁচানোর পথ।
Read full story in English