দুয়ারে মহালয়া, ওই দিন থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়ে যায় দুর্গাপুজো। প্যান্ডেল উদ্বোধন, প্ল্যান বানানো, ঘোরাঘুরি, খাওয়া-দাওয়া, আড্ডা, পুজোর প্রেম, ষষ্ঠীর বোধন থেকে দশমীর ভাসান আর তারপর একেবারে লক্ষ্মীপুজো অবধি চলে পুজোর মরশুম। কিন্তু এসবের আগেও পুজো আসছে এই অনুভূতিটা ঠিক করে আসে না যতক্ষণ না পুজোর শপিং বা পুজোর কেনাকাটা শেষ হচ্ছে, তাই না? পুজোর নতুন কেনাকাটা ছাড়া দুর্গাপুজো যেন অসম্পূর্ণ। বর্তমানে যদিও অনেক অপশন এসে গেছে আমাদের চেনা-পরিচিত দোকানের পাশাপাশি। ক্রেতাদের আরামের কথা ভেবে খুলেছে বিভিন্ন শপিং মল এবং তারও পরে সবার হাতে হাতে মোবাইলের মাধ্যমে এসেছে অনলাইন শপিং-এর মত অপশন। নিজের সুবিধামত একাধিক জিনিসের মধ্যে ক্রেতারা বেছে নিতে পারছে তাঁদের মনের মত জিনিসটা।
এমন অবস্থায় প্রশ্ন আসতেই পারে যে তাহলে এত সুবিধা সত্ত্বেও কতজন যাচ্ছে মার্কেটে নেমে নিজের হাতে নেড়েচেড়ে জিনিস কিনতে? বিগত প্রায় প্রত্যেক বছর পুজোর মরশুমে যেখানে ব্যবসায়ীরা একেবারে দম ফেলার সময় পান না, সেখানে এবছরও কি একই অবস্থা নাকি কিছু পরিবর্তন এসেছে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা ঘুরে দেখে দক্ষিণ কলকাতার গড়িয়াহাট বাজার।
এই গড়িয়াহাট নামকরণের সবথেকে জনপ্রিয় মতটি হল, এটি গৌড়ীয় সম্প্রদায়ের আবাসভূমি। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু তাঁর নীলাচল যাত্রায় আদিগঙ্গার মধ্য দিয়ে যাত্রা করেন, বর্তমান গড়িয়ার কাছে তিনি থামেন এবং তারপর থেকেই অঞ্চলে বৈষ্ণবরা থাকতে শুরু করে। আরও একটি উল্লেখযোগ্য প্রমাণ হল, গড়িয়া সন্নিহিত একটি বিস্তীর্ণ অঞ্চলের নাম বৈষ্ণবঘাটা মানে বৈষ্ণবদের ঘাঁটি। সুতরাং এই অঞ্চলে এক সময়ে অনেক বৈষ্ণব বসবাস করতেন। গড়িয়া অঞ্চলে যে হাট বসত, তার নামেই এই স্থানটির নামকরণ গড়িয়াহাট অথবা গড়িয়াহাটা।
আরও পড়ুন ১৫০ বছর ধরে বাঙালির মণিকোঠায়, জাপানি বোমাও ক্ষতি করতে পারেনি হাতিবাগান বাজারের
এই পুজোর মরশুমে কী অবস্থা গড়িয়াহাট বাজারের? বিক্রিবাট্টা কেমন হচ্ছে? ব্যবসায়ীরা কেমন বাধার সম্মুখীন হচ্ছে? - জানাচ্ছেন প্রায় দেড়/দুই দশক ধরে গড়িয়াহাটে প্রসাধনী দ্রব্যের ব্যবসা করা ক্ষুদিরাম। তিনি বলেন, “আমি এই দোকানটা তৈরি করে প্রায় ১৫-২০ বছর ধরে এখানে ব্যবসা করছি। এই বছর বিক্রিবাট্টা খুব একটা ভাল নেই, তার উপর বৃষ্টি-বাদলা হচ্ছে তাতে ব্যবসা আরও মার খাচ্ছে, কাস্টমাররা এখন খুব বেশি খরচ করতে চাইছে না।” কেন এমনটা হল? এর কারণ হিসাবে তিনি বলেন, “সত্যি কথা বলতে কী, লকডাউন হওয়াতে লোকের হাতে টাকাপয়সাও এখন কমে গেছে। দুবছর আগেও যেমন একটা বাজার ছিল মোটামুটি এখন সেই বাজার নেই। সব তো দেখছেন বসে আছে, এখন বসে থাকার সময়, বলুন তো? কত ভাল বাজার যায় পুজোর সময়। তাও যাঁরা আসছে তাঁরা হয়তো আগে দুটো জিনিস কিনত, তারা এখন একটা কিনেই চালিয়ে দিচ্ছে কোনওরকমে। এই এভাবেই চলছে আর কী।”
এ তো গেল প্রসাধনী দ্রব্যের কথা, কিন্তু পুজোয় সকলের কাছেই যেটা অন্যতম আকর্ষণীয়, সেই জামাকাপড়? পোশাকের ব্যবসায়ীদের কী বক্তব্য? গড়িয়াহাট মার্কেটে পোশাকের ব্যবসায়ী হরিদাস কুণ্ডু জানান, তিনি প্রায় ৪৫ বছর ধরে তাঁর দোকান চালাচ্ছেন। তিনি বলেন “বারো মাস আমার ব্যবসা চলে। পুজোর বাজারের কথা বলতে গেলে অন্যান্যবারের থেকে এবারে বাজারের অবস্থা খুব খারাপ। মানে এই লকডাউনের পরেও যে বাজারটা আমরা পেয়েছিলাম, এবারের এই দুর্গাপুজোয় সেটা কিন্তু দেখতে পাচ্ছি না। তবে এখন আপাতত এরকম চলছি, জানি না আগামী দশদিনে কী হবে? অবশ্য আমাদের বাজার হয় লাস্টের দিকেই।”
অনলাইনে জামাকাপড় কেনাকাটার যে বাজার তার সঙ্গে টেক্কা দিতে হরিদাসের মত ব্যবসায়ীদের একটু চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে। হরিদাস বলেন, “এখন অনলাইনেই তো অনেকেই অনেককিছু কেনাকাটা করছে বা শপিং মল, একটা জায়গাতেই অনেককিছু পেয়ে যাচ্ছে। এতে আমাদের একটু অসুবিধা হয়ে যাচ্ছে আরকি।” সবশেষে তিনি একটু খেদ করেই বলেন, “আমাদের তো আশা অনেক কিছুই আছে কিন্তু সেসব হচ্ছেটা কোথায়?”
এবারের পুজোর বাজার নিয়ে গড়িয়াহাটের মোড়ের শোভা ট্রেডার্স অ্যাসেম্বলির ডিরেক্টর মানবেন্দ্র সাহা বলেন “এবারের পুজোয় বিক্রি খুব খারাপ নয়, ভালোই হচ্ছে।” এমন বড় মাপের ব্যবসায়ী হয়েও অনলাইন শপিং-এর চাহিদা এবং তার ব্যাপ্তির প্রশ্নে তাঁর গলায় শোনা গেল যে তাঁকেও প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে হচ্ছে। তিনি বলেন, “চ্যালেঞ্জ ফিল করছি, কমবেশি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে।” কিন্তু তবুও তাঁর দোকানের শাড়ির চাহিদা কমেনি। এবছর পুজোয় ফ্যাশন ট্রেন্ডে কেমন শাড়ি থাকছে, সে প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “সবরকমের শাড়িই পুজোর ফ্যাশনে ট্রেন্ডে চলছে। আমরা সারা ভারতবর্ষ থেকে শাড়ি নিয়ে আসি, সব শাড়িই বিক্রি হচ্ছে। যেমন, সাউথের শাড়ি, সাউথ কটন, উত্তর-পূর্বের যেমন অসমের গুয়াহাটির শাড়ি, মধ্যপ্রদেশ, উড়িষ্যার ভুবনেশ্বরের শাড়ি, পশ্চিমের বোম্বাই শাড়ি, গুজরাটের সুরাটের শাড়ি, দিল্লির প্রিন্টেড শাড়ি আর কত বলব? বলে শেষ করা যাবে না। সব শাড়িই ডিমান্ডে আছে।”
আরও পড়ুন অনলাইন শপিংয়ের দাপটে অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে ‘হগসাহেবের বাজার’, জানেন এর ইতিহাস?
পুজো এসেছে অথচ গড়িয়াহাটে শপিং করা হবে না, এটা তো হতে পারে না! এ আবেগ থেকে অনেকেই পুজোর আগে অনলাইন বা শপিং মলের পাশাপাশি একবার অন্তত এ মার্কেটে ঢুঁ মারেনই। বহু বছরের প্রাচীন এই বাজারের ব্যবসায়ীরা তাই বিভিন্ন প্রতিযোগিতা, দুর্যোগ, মহামারি, লকডাউন ইত্যাদি কাটিয়ে এবছর দুর্গাপুজোয় কিন্তু আবার আশায় বুক বেঁধে ব্যবসা চালাচ্ছে, এ কথা বলাই যায়।