'হোক কলরবে'র যাদবপুর ফের তাণ্ডবের সাক্ষী। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে ঘেরাও, গো ব্যাক স্লোগানের সঙ্গেই চলল মারধর। দুপুর থেকে বিকেল, বামপন্থী একদল পড়ুয়ার এই আচরণের পর আসরে নামে এবিভিপি। সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে ও ভেতরে চলে ভাঙচুর। তখনও ঘেরাওমুক্ত হতে পারেননি বাবুল সুপ্রিয়। মন্ত্রী ও বিক্ষোভকারীদের শানিত বাক্যবাণে তখন উত্তেজনা চূড়ান্ত পর্যয়ে। এইসবের মধ্যেই, আসরে হাজির হন রাজ্যপাল জগদীশ ধনকড়। ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে মুখ্যমন্ত্রীও মুখ্যসচিব মলয় দের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। তারপর, নিজেই হাজির হন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাতেই যেন আগুনে ঘি পড়ে। রাজ্যপালের গাড়ি আটকেও চলে বামপন্থী পড়ুয়াদের বিক্ষোভ। ধনকড়ের পদক্ষেপের সমালোচনায় মুখর তৃণমূল। বিজেপি নেতাকে উদ্ধার করতেই রাজ্যপাল বিশ্ববিদ্যালয় গিয়েছিলেন বলে বিবৃতিতে দাবি করে তৃণমূল। শুক্রবার থানায় অভিযোগ দায়ের করে বাম ও অগ্নিমিত্রা পাল সহ এবিভিপি শিবির। বৃহস্পতিবারের, বাবুল সুপ্রিয় থেকে রাজ্যপাল, শাসক দল, প্রশাসন, যাদবপুরকাণ্ডের জড়িত নানা চরিত্র তাঁদের নিজেদের মত করে যুক্তির ডালি সাজিয়েছেন। ঘটনা পরম্পরা নিম্নরূপ....
কী কারণে বিক্ষোভ?
বৃহস্পতিবার দুপুর আড়াইটে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে এবিভিপির ডাকে নবীনবরণ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যান কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়। কিন্তু, যাদবপুরে পৌঁছতেই ঘেরাও করা হয় তাঁকে। অতি বামপন্থী একদল পড়ুয়া মন্ত্রীকে অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বাধা দেয়। চলে 'গো ব্যাক' স্লোগান। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সুরঞ্জন দাস হস্তক্ষেপ করলেও তাতে কাজ হয়নি। প্রায় এক ঘন্টা অরাজক পরিস্থিতির পর কোনও মতে নবীনবরণ অনুষ্ঠানে যোগ দেন বাবুল সুপ্রিয়। বাইরে উত্তাপ অবশ্য তখন উর্ধ্বমুখী। অনুষ্ঠান শেষে বাইরে বের হলেই প্রায় পাঁচ ঘন্টা ফের ঘেরাও করা হয় কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে। বিক্ষোভকারীরা জানায়, বাবুল সুপ্রিয়কে কোনও মতেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরোতে দেওয়া হবে না।
আরও পড়ুন: রাজীব কুমারের বাড়িতে ফের সিবিআই, তল্লাশি বিষ্ণুপুরের রিসর্টেও
কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে ঘেরাও প্রসঙ্গে কী বলেছিলেন বিক্ষোভকারীরা?
অতি বাম আন্দলনকারী পড়ুয়াদের দাবি, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু বিক্ষোভকারীকে ভয়াবহ পরিণতির হুমকি দিয়েছিলেন। মহিলা পড়ুয়াদের নিগৃহ করেন। এই অবস্থায় ক্ষমা চাইতে হবে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে। না হলে ঘেরাও মুক্ত করা হবে না তাঁকে।
বাবুল সুপ্রিয় ও উপাচার্য়ের মধ্যে কথোপকথন
পড়ুয়াদের ঘেরাও ও স্লোগানে তখন মুখোরিত যাদবপুর। সেই সময়ই মন্ত্রীর কাছে যান উপাচার্য সুরঞ্জন দাস। তাঁকে অনুষ্ঠাণে যোগ দেওয়ার কথা বলেন উপাচার্য। সুরঞ্জনবাবুকে দেখেই তাঁর বিরুদ্ধে খড়গহস্ত হন মন্ত্রী। জানতে চান কেন একজন মন্ত্রী, জনপ্রতিনিধি হিসাবে বিশ্ববিদ্য়ালয়ে প্রবেশের সময় তাঁকে স্বাগত জানানো হয়নি? জবাবে উপাচার্য বলেন তাঁকে ওই নির্দিষ্ট অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। এরপরই চড়া সুরে সুরঞ্জন দাসের বিরুদ্ধেই গতকালের ঘটনার দায় চাপান বাবুল সুপ্রিয়। বলেন, 'আমি আমন্ত্রিত ছিলাম। আপনার স্বাগত জানানো উচিত ছিল। আমি জানি আপনি বামপন্থী, আর আপনাদের মত মানুষদের জন্যই এই ধরণের নৈরাজ্যের সৃষ্টি হয়েছে।' তাঁর সংযোজন, 'একজন কেন্দ্রীয়মন্ত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ে আসছেন। কিন্তু, আপনি চাইলেন এই ধরণের ঘটনা ঘটুক।'
অনুষ্ঠানের পর ফের তাঁকে নিগ্রহের অভিযোগ বাবুলের
বৃহস্পতিবার নবীনবরণ অনুষ্ঠান থেকে বেরিয়ে আসার পর ফের বিক্ষোভের মুখে পড়তে হয় কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে। তাঁকে নিগ্রহ ও মারধর করা হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়। একটা সময়, পড়ুয়াদের সঙ্গে ধস্তাধস্তিতে চশমা খুলে যায় বাবুলের। পাশে দাঁড়িয়ে তাকা উপাচার্যকে তখন মন্ত্রী ক্যাম্পাসে পুলিশ ডাকতে আর্জি জানান। মন্ত্রীর আর্জি নাকচ করে উপাচার্য সুরঞ্জন জাস জানিয়ে দেন ক্যাম্পাসে কোনও মতেই পুলিশ ডাকবেন না তিনি। যুক্তি হিসাবে, ২০১৪ সালে পড়ুয়াদের উপর পুলিশি অত্যাচারের কথা তুলে ধরেন তিনি। এই সময় উপাচার্য -মন্ত্রী বিবাদ চরমে পৌঁছয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই অসুস্থ বোধ করায় নিকটবর্তী হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি।
আরও পড়ুন: কে এই রাজীব কুমার, যাঁকে হন্যে হয়ে খুঁজছে সিবিআই?
কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া
যাদবপুর বিশ্বিদ্য়ালয়ে তাঁকে নিগ্রহের অভিযোগ করেন বাবুল সুপ্রিয়। তাঁর দাবি, 'আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া হয়। আমার চুল টানা হয়েছে। লাথি মারা ও মারধর করা হয়েছে। এই ধরণের অভ্যবতা যাদবপুরের মত পড়ুয়াদের থেকে আশা করা যায় না। ওদের সমস্যা থাকলে আলোচনা করতে পারত, বিতর্ক করা যেত। কিন্তু, তাদের নিগ্রহ মেনে নেওয়া যায় না। তারা আমাকে কোথাও যাওয়া থেকে রুখতে পারে না।' রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থার শোচনীয় অবস্থা বলে তোপ দাগেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী।
বিক্ষোভকারীদের অভিয়োগ, মন্ত্রী তাদের অপমান করে হেনস্থা করেছেন। ক্ষমা চাইতে হবে তাঁকে। পাল্টা বাবুল সুপ্রিয় বলেন, 'পড়ুয়ারা অসভ্যতা করল, তাহলে আমি কেন ক্ষমা চাইবো? এরা দুষ্কৃতী। এদের বহিষ্কার করা প্রয়োজন।'
কী কারণে রাজ্যপাল ঘটনায় হস্তক্ষেপ করলেন?
দুপুর থেকে যাদবপুরে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর আটকে থাকার ঘটনায় উদ্বেগ প্রপকাষ করেন রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়। মুখ্যমন্ত্রী ও মুখ্য-সচিবকে ফোন করেন তিনি। পরে, সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে উপস্থিত হন তিনি। আটক মন্ত্রীকে নিজের গাড়িতে করে বাইরে বের করার চেষ্টা করেন রাজ্যপাল। তবে, প্রায় একঘন্টা তাঁদের গাড়িকে বের হতে দেওয়া হয়নি। পরে, বিশাল পুলিশ বাহিনী বিশ্ববিদ্য়ালয়ের মধ্যে প্রবেশ করে রাজ্যপাল ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর কনভয়কে বাইরে বের করে।
কী বলেছিলেন রাজ্যপাল?
'আমাকে যাদবপুরে যেতেই হবে। উপাচার্য ও সহ-উপাচার্য বিশ্বদ্যালয় ছেড়ে চলে গিলেও সেখানে আটকে রয়েছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। সমাধানের সব পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সমস্যা সমাধানে আমাকেই ব্যক্তিগতভাবে সেখানে যেতে হবে।' পরে ইন্ডিয়ার এক্সপ্রেসকে রাজ্যপাল বলেন, 'আমি আচার্য যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের। বিক্ষোভকারী পড়ুয়াদের বলেছি, আমি তাদের অভিযোগের কথা শুনব। প্রয়োজনে সমাধানও করব।'
রাজ্যভবনের তরফে বিবৃতি দিয়ে বলা হয়, যাদবপুরের ঘটনা রাজ্যপাল খুবই গুরুত্বসহকারে দেখছেন। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে এতক্ষণ এইভাবে আটকে রাখা রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলের প্রতিফলনের প্রকাশ
আরও পড়ুন: গোলকিপার পুরস্কার পেতে চলেছেন মোদী
ঘটনার সমালোচনা করেছে বিজেপি
'রাজ্যে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুরক্ষিত নন, আইন-শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে। তাই ঘেরাও মন্ত্রীকে উদ্ধারে হস্তক্ষেপ করতে হচ্ছে রাজ্যপালকে। আমরা এই ধরণের বিষয়কে সমর্থন করি না।' দাবি রাজ্য বিজেপি সভাপতি দিলীপ ঘোষের। বিজেপি সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহকে বৃহস্পতিবারের গোটা ঘটনা জানিয়ে চিঠি লেখেন দিলীপ ঘোষ। তৃণমূল নেতা এও রাজ্যের মন্ত্রী তাপস রায় বলেন, 'গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়, জনপ্রতিনিধিপর উপর এই ধরণের নিগ্রহ মেনে নেওয়া যায় না।'
তৃণমূলের কী অবস্থান?
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে রাজ্যপালের সঙ্গে সঙ্ঘাতে রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল। দলের মহহাসচিব এক বিবৃতিতে জানান, 'রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধান নির্বাচিত সরকারকে না জানিয়েই ঘটনাস্থলে চলে যান। তিনি বিজেপি নেতা বাবুল সুপ্রিয়কে উদ্ধার করতেই সেখানে গিয়েছিলেন।' তাঁর সংযুক্তি, 'মুখ্যমন্ত্রীর নিষেধ সত্ত্বেও যাদবপুরে চলে যান রাজ্য়পাল, যা দুর্ভাগ্যজনক।' পার্থবাবু বিবৃতি জানান, 'উপাচার্যের অনুমতি না মেলায় পুলিশ বিশ্ববিদ্য়ালয়ের মধ্যে প্রবেশ করতে পারেনি। মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে জানিয়েছিলেন, ওই মুহূর্তে ঘটনাস্থলে রাজ্যপালের মত ব্যক্তিত্যের যাওয়া উচিত নয়। সরকারকে কিছু সময় দিলে তা শান্তিপূর্ণভাবে মিটিয়ে ফেলা হবে। কিন্তি, রাজ্যপাল সেখানে বিজেপির সুববিধা করতে চলে গেলেন।'
Read the full story in English