ফি বছরই সংবাদপত্র শিরোনামে উঠে আসে, মহানগরীর বুকে পুরনো বাড়ি ভেঙে মৃত্যুর একাধিক খবর। উত্তর কলকাতার রাস্তার চারপাশ ভালভাবে লক্ষ করলে এই রকম পুরনো বাড়ি চোখে পড়বে, তার কোনওটির বয়স, দু’শো বছর, কোনওটি আবার তার থেকেও পুরনো। দীর্ঘ দিন সংস্কার না হওয়ার ফলে বাড়িগুলি প্রায় জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। তার মধ্যেই প্রাণের ঝুঁকি নিয়েই বাস করছেন মানুষজন। নীচে রমরমিয়ে চলছে দোকানদারি। বর্ষার মরসুমে প্রতি বছরই কলকাতা শহরে একাধিক জীর্ণ বাড়ি ভেঙে পড়ে। কলকাতা পুরসভা এই ধরনের বাড়ির গায়ে ‘বিপজ্জনক’ নোটিস ঝুলিয়ে দেয় বটে, কিন্তু সংস্কারের কাজ প্রায় হয়ই না। তার জন্য বাড়ির মালিকের সঙ্গে ভাড়াটেদের দ্বন্দ্বকেই প্রধান কারণ হিসাবে অধিকাংশ সময়ে চিহ্নিত করেন পুর কর্তৃপক্ষ।
অভিযোগ, কম ভাড়ার পুরনো বাড়িগুলিতে পুরসভার পক্ষ থেকে বিপজ্জনক বাড়ির নোটিস টাঙানো হয়। কিন্তু সেখানে ব্যবসা বা দোকান বন্ধ করার কোনও চেষ্টা পুর কর্তৃপক্ষ করেন না। সেই সমস্ত দোকান বা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের ট্রেড লাইসেন্স বছরের পর বছর নবীকরণ করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে জল, নিকাশি ও বিদ্যুতের সংযোগও অব্যাহত থাকছে। পুর কর্তৃপক্ষ বাণিজ্যকর আদায়েও পিছপা হচ্ছেন না। অর্থাৎ, এক দিকে ওই সমস্ত ‘বিপজ্জনক’ বাড়িতে বসবাস করতে বারণ করা হচ্ছে, আবার অন্য দিকে সমস্ত পরিষেবা বহাল রেখে নিজেদের সিদ্ধান্তকেই হাস্যকর প্রতিপন্ন করছে পুরসভা।
কলকাতা পুরসভা এলাকায় এই মুহূর্তে তিন হাজারেরও বেশি বিপজ্জনক বাড়ি এবং একশোরও বেশি অতি বিপজ্জনক বাড়ি রয়েছে। এর মধ্যে উত্তর কলকাতায় বিপজ্জনক বাড়ির সংখ্যা বেশি। অথচ, সেই সব বাড়িতেই বছরের পর বছর বসবাস করে যাচ্ছেন ভাড়াটেরা। উত্তর কলকাতার বেশ কয়েকটি বিপজ্জনক বাড়ির ভাড়াটেরা জানাচ্ছেন, বিকল্প কোনও ব্যবস্থা না থাকার কারণেই বিপজ্জনক জেনেও সেই বাড়ি ছেড়ে সরতে চান না তাঁরা।
তেমনই পগেয়া স্ট্রিটের একটি পুরনো বাড়ির ভাড়াটিয়া বিপিন হরিজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছে, প্রায় ৬০ বছর ধরেই সেই বাড়িতেই বসবাস হরিজন পরিবারের। দেওয়াল খসে পড়েছে। মাথায় যে কোনও সময়েই ভেঙে পড়েতে পারে বিশাল চাঁই। তাও এখানে থাকতে হচ্ছে। কারণ বিকল্প কোথাও যাওয়ার নেই। সেই বাড়িতে তার সঙ্গেই বেশ কয়েকটি পরিবার ভাড়ায় থাকেন। তাঁর অভিযোগ, ‘মালিক বাড়ি সারানোর ব্যাপারে সেভাবে কোন রকম গা করেন না। সেই সঙ্গে পুরনো শরিকি বিবাদ তো আছেই’। এর মাঝে পড়ে কোনও উপায় না দেখে এখানেই বিপদ মাথায় নিয়ে পরিবার সমেত থাকতে হচ্ছে, বিপিনবাবুকে।
স্থানীয় একটি কাপড়ের দোকানে কাজ করেন বিপিন। তাঁর কথায়, ‘প্রতিবছর, বর্ষার সময় প্রাণ হাতে করে থাকতে হয়। যখন কোনও বাড়ি ভেঙে মৃত্যুর খবর সামনে আসে, ভয়ে বুক দুরদুর করে। কিন্তু এভাবেই একের পর এক বর্ষা পার হয়ে চলেছে’। অন্যদিকে সেই বাড়ির নিচেই সারি দিয়ে দোকান। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত দোকানেই দিন কাটান দোকানের মালিক সুভাষ সাহা। তাঁর কথায়, ‘ভয় তো হয়ই, কিন্তু তা বললে তো পেট চলবে না।' এখানে কয়েক দশক ধরেই দোকান চালান তিনি। তিনি বলেন, 'মাঝে মধ্যেই পুরসভার তরফে বাড়ি ঘুরে দেখে যান, আধিকারিকরা কিন্তু সংস্কার হচ্ছে কই’! তার সাফ জবাব, ‘ব্যবসা করতে আসি, ব্যবসা করি চলে যাই, বাকি কিছু দেখা আমার কাজ নয়, তার জন্য বাড়িওয়ালা, পুরসভা রয়েছে’।
কয়েকদিন আগেই দুর্গাপুজোর শুরুতেই বড়বাজারের রবীন্দ্র সরণির একটি বিপজ্জনক বাড়ির একাংশ ভেঙে পড়ে মৃত্যু হয়েছিল দুই পথচারীর। তার পরেও সেই বাড়িতেই বাস করছেন ভাড়াটেরা। কারণটা সেই একই, বিকল্প কোথাও মাথা গোঁজার ঠাই নেই। শহরের সর্বত্র বিপজ্জনক বাড়িতে বসবাসকারী ভাড়াটেরা একই কারণ দেখিয়ে থাকেন। কোথাও আবার বাড়ি সংস্কার না হওয়ার পিছনে মালিক ও ভাড়াটেরা একে অপরের ঘাড়ে দোষ চাপান। এর মাঝেই প্রতি বছর একের পর এক পুরনো বাড়ি হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে মৃত্যু মিছিল চলতেই থাকে। টনক নড়ে না পুরসভার অভিযোগ, শহরের বাসিন্দাদের।
ইন্ডিয়ানএক্সপ্রেসবাংলাএখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন