শহরের মাঝে মোটামুটি দুই বছরের ব্যবধানে পোস্তা এবং মাঝেরহাট ব্রিজ ভেঙে পড়ার পর থেকে ধীরেসুস্থে টনক নড়ে কলকাতা মেট্রোপলিটন ডেভেলপমেন্ট অথরিটি, অর্থাৎ কেএমডিএ'র। কেমন আছে শহরের বাকি সব সেতু, তা খতিয়ে দেখতে চলে একের পর এক স্বাস্থ্য পরীক্ষা। মেশিন পত্তর, বিশেষজ্ঞের দল, সকলের উপস্থিতিতে ব্রিজের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে তৈরি করা হয় 'প্রেসক্রিপশন'। সেইমতো নির্দিষ্ট কিছু ব্রিজ বন্ধ করে চলে তাদের 'চিকিৎসা'।
বর্তমানে জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে টালা ব্রিজ। বন্ধ রাখা হয়েছে ভারী গাড়ির যাতায়াত। তুলে ফেলা হয়েছে সিমেন্টের ভারী স্ল্যাব। শোনা যাচ্ছে, সেতুটি পুরোপুরি ভেঙে ফেলার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা, যে বিষয়ে এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় নি সরকারের তরফে।
কিন্তু শহরের বাকি সেতুগুলি কেমন আছে? তাদের চেহারা ফেরাতে রঙের প্রলেপ চাপানো হয়েছে হয়তো, কিন্তু ব্রিজের পরিকাঠামোর কী হাল? অন্যদিকে, মাঝেরহাটে নতুন ব্রিজ তৈরির কাজই বা কতদূর?
মাঝেরহাট সেতু ভাঙার বর্ষপূর্তি হয়েছে গত ৪ সেপ্টেম্বর। বছর ঘুরে আরো দেড় মাস অতিক্রান্ত। এখনও তৈরি হয়নি ব্রিজের পরিকাঠামো। নাজেহাল অবস্থা স্থানীয় বাসিন্দাদের। মাথা সমান উঁচু লোহার থাম, বড় বড় কংক্রিটের বোল্ডার, তার ওপর দিয়ে নিত্যদিন যাতায়াত করে কোনোরকমে স্টেশন পৌঁছাতে হয় এলাকার মানুষকে। প্রতিদিন কার্যত জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যাতায়াত করেন তাঁরা।
ট্রেনের টাইম হওয়া মাত্রই নিত্যদিনের বিপদ অগ্রাহ্য করে লোহার বিমের ওপর দিয়ে ছুটে চলেন নিত্যযাত্রীরা। পা পিছলে বিমের উপর থেকে একবার পড়লে রক্ষে নেই আর। কিন্তু কী আর করা যাবে, মাঝেরহাট ব্রিজ বিপর্যয়ের পর থেকে এমনভাবেই যাতায়াত করছেন এলাকার বাসিন্দারা। এবং এই হয়রানি যে দীর্ঘমেয়াদী হতে চলেছে, তাও মেনেই নিয়েছেন তাঁরা।
নিত্যযাত্রী রমেশ পাল জানিয়েছেন, "জানি না ব্রিজ কবে তৈরি হবে। স্টেশনে পৌঁছনো আমাদের নিত্যদিনের অশান্তি। একেবারে পাহাড়-পর্বত টপকে পৌঁছতে হয় স্টেশনে।"
এবার আসা যাক বালিগঞ্জ ব্রিজ তথা বিজন সেতুর হালহকিকতে। জং ধরেছে লোহার তৈরি জয়েন্টে। ব্রিজের তলদেশ থেকে একাধিক জায়গায় খসে পড়েছে চাঙড়। তার ওপর জ্বলজ্বল করছে নতুন রঙের প্রলেপ। ব্রিজের তলায় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গড়ে উঠেছে একাধিক দোতলা বাড়ি, তাদের একাধিক ঘর। সেই ঘরগুলিতে রয়েছে হোটেল, পশ্চিমবঙ্গ পরিবহণের অফিস, সমবায়িকা, হোমিও ক্লিনিক, ইত্যাদি প্রভৃতি। বাহ্যিক অবস্থা দেখে এক নজরেই বলে দেওয়া যায়, ব্রিজের অবস্থা মোটেই ভালো নেই।
ব্রিজের অন্দরমহলের স্বাস্থ্যও ভালো নেই, তাই স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর 'রোগীর' তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এই ব্রিজের নামও। ব্রিজের উপর রয়েছে বিশাল আকারের গর্ত। চারপাশে বটগাছের বসবাস যে অনেক দিনের, তা বলে দেবে গাছের শিকড়। ফাটল যে কে সেই রয়ে গেছে। কিন্তু তার ওপরই চাপানো হয়েছে মোটা রঙের প্রলেপ।
এদিকে কয়েক মাস আগে সারাই হয়েছে ঢাকুরিয়া ব্রিজ তথা চৈতন্য মহাপ্রভু সেতু। ইঁদুরের উৎপাতে বসে গিয়েছিল ব্রিজের একাংশ। কেমিক্যাল ব্যবহার করে সেই ইঁদুরের উৎপাত কমানো গেছে। তবে ব্রিজের স্বাস্থ্য নিয়ে এখনও চিন্তিত এলাকার বাসিন্দারা। তাঁদের বক্তব্য, আগের মতোই কেঁপে চলেছে ব্রিজ। অতএব সমস্যা এখনও মেটেনি বলেই তাঁদের মত। তাঁদেরও প্রশ্ন "শুধু রঙের প্রলেপ" নিয়ে। ব্রিজের ওপরে বেশ কিছুটা জায়গায় বড় গর্ত হয়ে রয়েছে। কিন্তু কেএমডিএ-র আধিকারিকরা জানিয়ে দিয়েছেন এই ব্রিজ আপাতত সুরক্ষিত।
শহরের উত্তরে টালার পর এবার বেলগাছিয়া ব্রিজের স্বাস্থ্য পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে প্রশাসনের তরফে। আগামী বৃহস্পতিবারের মধ্যেই পরীক্ষা করা হবে ব্রিজের স্বাস্থ্য। বিশেষ চিন্তার কারণ এই যে এমনিতেই বেলগাছিয়া ব্রিজের হাল ভালো নয়, তার ওপর টালা ব্রিজ আংশিক বন্ধ থাকার জেরে চাপ ক্রমশ বাড়ছে এই ব্রিজের ওপর।
পুজোর আগেই শিয়ালদহ সেতু, কালীঘাট সেতু, বাঘাযতীন সেতু, অরবিন্দ সেতু, চিংড়িহাটা সেতু, বঙ্কিম সেতু, চেতলা লকগেট সেতুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়। শিয়ালদহ সেতুর অবস্থাও বিশেষ ভালো নয়। বিশেষজ্ঞের পরামর্শে সরানো হবে ট্রামলাইন ও পিচের আস্তরণ। এখনই মেরামতি করা সম্ভব না হলেও ব্রিজের ওপর ওজন কমানো জরুরি বলে মত বিশেষজ্ঞদের।
এদিকে স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর মেরামতির তালিকাভুক্ত হয়েছে বাঘাযতীন সেতু, বিজন সেতু, দুর্গাপুর সেতু, (টালিগঞ্জের) করুণাময়ী সেতু, চেতলা সেতু, (বাইপাসের ওপর) আম্বেদকর সেতু এবং চিৎপুর ক্যানাল সেতু।