সিধু জ্যাঠার কথা মনে আছে? আরে ফেলুদার সিধু জ্যাঠা! যিনি কিনা ছিলেন চলমান লাইব্রেরী। কলকাতার কোথায় কবে কে কী করেছিলেন, কোন ঘটনা কোন সময় হয়েছিল, এসবই ছিল তাঁর নখদর্পণে। পাণ্ডুলিপির মতন মোটা মোটা খাতায় যত্ন করে রাখা থাকতো পুরনো খবরের কাগজের কাট আউট। এগুলোই ছিল সিধু জ্যাঠার নেশা। আবার 'আগন্তুক' ছবিতে মনমোহন মিত্তির! যার নানা দেশের নানা ধরনের মুদ্রা জমানোর শখ ছিল। এরকম শখ বহু মানুষেরই থাকে।
যেমনটা বাস্তবে রয়েছে কলেজ স্ট্রিটের স্বপন দত্তের। তাঁর শখ কলকাতা শহর তো বটেই দেশের নানা প্রান্তে যত অর্ধমৃত ঘড়ি রয়েছে তা বাঁচিয়ে তোলা। এই শখ তিনি পেয়েছেন বংশপরম্পরা সূত্রে। এই শহরের যত ক্লক টাওয়ার রয়েছে তাঁর সব কটা ঘড়ির রক্ষণা বেক্ষণের মূল দায়িত্বে রয়েছেন স্বপন বাবু। সকলের কাছে পরিচিত কলকাতার 'ঘড়িবাবু' নামে।
কলকাতার আনাচে কানাচে ছড়িয়েছে অনেক ঘড়ি। কিছু ঘড়ি এমনও রয়েছে যার বয়স হয়তো ব্রিটিশ সময়কাল থেকেও পুরনো। মাথা উঁচু করা পুরনো গম্বুজের গায়ের ঘড়িগুলো নানা সময়ের ইতিহাসের সাক্ষী। এই সময়কেই বংশপরম্পরায় বাঁচিয়ে রেখেছেন স্বপন দত্ত। গির্জার ঘড়ি, ডাকঘরের ঘড়ি, মানিকতলা বাজারের ঘড়ি সব কটাকে নিয়ম করে দম দিয়ে আসেন ঘড়িবাবুই। নয় নয় করে পঞ্চাশ বছরেরও বেশী সময় ধরে ঘড়ি সঙ্গেই ঘর করছেন। বাবা পতিতপাবন দত্ত নিজেও ছিলেন একজন নামজাদা ঘড়ি বিশারদ।
বর্তমানে স্বপন বাবুর হাতে কলকাতার কত শত ঘড়ি রয়েছে তাঁর হিসেব করতে বসলে নিজেই হিসেব গুলিয়ে ফেলেন। যে কটা সহজে গড় গড় করে বলে ফেলতে পারেন তার মধ্যে রয়েছে, নিউ মার্কেটের দুরন্ত ওয়েস্ট মিনিস্টার ক্লক, মানিকতলা বাজারের জার্মান ক্লক, ধর্মতলা চার্চের ডিং-ডং কোয়ার্টার চাইমিং ক্লক, জোড়া গির্জা, জিপিওর ঘড়ি। এ সবকটারই গুরুদায়িত্বে রয়েছেন ঘড়িবাবু নিজেই।
দেড়'শ বছরেরও বেশী সময় ধরে ঘড়ির সঙ্গে দত্ত পরিবারের সম্পর্ক। স্বপনবাবু নিজের দোকানে বসেই একশ বছরের হ্যামিলটনের ঘড়ির স্প্রিং ঠিক করতে করতে বলেন, 'শুরু হয়েছিল বাবা ঠাকুরদার আমল থেকে। কুক অ্যান্ড কেলভি, হ্যামিলটন, জেমস মারে এই সমস্ত ঘড়ির বিলিতি কোম্পানি। এই সবই সাহেবি আমল থেকে এই শহরে আছে। এই প্রতিটি সংস্থার চিফ টেকনিশিয়ান ছিলেন আমাদের পরিবারের কেউ না কেউ। কলকাতার হেরিটেজ ঘড়ির দেখভাল করার দায়িত্ব সেই দেড়’শ বছর আগে থেকেই দত্ত পরিবারের। আমার বড় ছেলে এই পেশায় না এলে দেড়’শ বছরের এই হেরিটেজ ব্যবসা লাটে উঠত। এখন ছেলেই ঘড়ি দেখভালের সমস্ত দায়িত্ব নিজের হাতে তুল নিয়েছে।'
শুধু শহরের ঘড়ির দায়িত্বে রয়েছেন তা নয়, স্বপনবাবুর তত্ত্বাবধানে যেমন দিল্লি, পাটনা রয়েছে, তেমনই রয়েছে নেপালের ঘড়িও। কলেজ স্ট্রিটের দোকান থেকে বেড়িয়ে ছেলেকে সঙ্গে নিয়েই গেলেন মানিকতলা বাজারের ঘড়িতে দম দিতে। ক্লক টাওয়ার রুম ঘুড়িয়ে দেখানোর সময় বলছিলেন, "হাত ঘড়ি এবং টাওয়ার ক্লক এই দুই ঘড়ির তফাৎ সম্বন্ধে ‘তফাত্টা খুবই সহজ। একটা চলে স্প্রিংয়ে, আর অন্যটা চলে ওয়েট প্রেশারে। বড় বড় লোহার ওজন ঝোলানো থাকে। এই ওজন যত লম্বা দড়িতে ঝুলবে তত বেশিক্ষণ দম থাকবে। যেমন এই শহরে সেন্টজন’স চার্চের দড়ির মাপ ছোট বলে রোজ দম দিতে হয়। আর জিপিওর ঘড়িতে দিতে হয় ২দিন অন্তর। লেকটাউনের বিগ বেন -এ দিতে হয় ৭ দিন অন্তর'। আগে আমি নিজেই এসব জায়গায় ঘড়িগুলো দেখে যেতাম এখন শরীরে পেরে উঠিনা, আমার লোকজনই সকালে বেড়িয়ে পড়েন সারাদিন শহরের সব ঘড়ির কলকব্জা চেক করে ফিরে আসে" ইংরেজ শাসন বা তার আগে থেকেও আজ অবধি এই শহরের দেওয়াল ঘড়িগুলো তিলোত্তমার সঙ্গে মানুষের জীবনকে ছন্দে বেঁধে রেখেছে। আর সময়কে ছন্দপতন হতে দেয়নি। ঘড়ি তৈরি থেকে দেখভাল। সবকিছুতেই ভরসা এই সঠিক সময়ের ভরসা ঘড়িবাবুই।