নির্ধারিত দিনের ১০০ দিন আগেই জন্ম হয় ঋদ্ধিস্মিত ঘোষের। কিন্তু চিকিৎসকদের চোখে সে তখন 'প্রি ম্যাচিওর বেবি'। পরিস্থিতি এমটাই ছিল যে বাঁচানো প্রায় অসম্ভব। তবু হাল ছাড়েনি কলকাতার ডাক্তারবাবুরা। আর এই হার না মানা মনোভাবেই এল বিরল সাফল্য। চিকিৎসার মাধ্যমে তিল তিল করে গড়ে তোলা হয় ঋদ্ধিস্মিতর অপূর্ণ শরীর। পুরো ঘটনাটাই যেন ম্যাজিকের মতো! ঋদ্ধিস্মিতর বাবা যতীন্দ্রনাথ ঘোষ ও মা ভাস্বতী ঘোষের দৃষ্টি আজও শূন্যে ভেসে যায় সে কথা মনে করলে। মায়ের গর্ভে থাকাকালীন ২৫ সপ্তাহের মাথায় পৃথিবীর বুকে ভুমিষ্ঠ হয় সে। এরপর দু-মাস দশ দিনের টানা চিকিৎসায় এখন আর পাঁচটি শিশুর মতই খিলখিল করে হাসছে ও খেলা করছে ফুটফুটে শিশুটি।
যতীন্দ্রনাথ বাবু ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা-কে বলেন,"গর্ভধারণের পাঁচ মাসের মাথায় হুগলির জাঙ্গিপাড়ার বাসিন্দা ভাস্বতী ঘোষের প্রসব যন্ত্রণা শুরু হয়। সঙ্গে সঙ্গে সল্টলেকের এক বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা তাঁকে। ডাক্তার জানিয়ে দেন, মায়ের 'প্ল্যাসেন্টাল অ্যাব্রাপশন' (গর্ভকালীন রক্তক্ষরণ) হয়েছে। ফলে, মায়ের জীবন বিপন্ন। তৎক্ষণাৎ শিশুকে বের করে আনতে হবে, আর এতে মাকে বাঁচানো সম্ভব হলেও সন্তানকে বাঁচানো সম্ভব কি না তা অনিশ্চিত।
নির্ধারিত দিনের ১০০ দিন আগেই ২৬ শে এপ্রিল ভূমিষ্ঠ হয় ঋদ্ধিস্মিত। প্রত্যাশিতভাবেই ডাক্তার জানায় 'প্রি ম্যাচিওর বেবি', ওজন মাত্র ৬৯০ গ্রাম। শরীরের একাধিক অঙ্গেরই কর্মক্ষমতা নেই। পরিণত হয়নি ফুসফুস-সহ শ্বাসযন্ত্র। ফলে, শরীরে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন ঠিকমত সরবরাহ হচ্ছে না। ফুসফুসের প্রকোষ্ঠগুলিও তৈরি হয়নি। ডাক্তাররা এসব কথা জানিয়ে দেওয়ার পর মন শক্ত করছিলেন 'বাবা' যতীন্দ্রনাথ ঘোষ। কিন্তু হাল ছাড়েননি ডাঃ সৌম্যব্রত আচার্য ও তাঁর টিম। ঋদ্ধিস্মিতর জন্য বসে পড়ে 'মেডিক্যাল বোর্ড'। শিশুটির প্রাণ বাঁচাতে তখন মরিয়া হয়ে উঠেছেন ডাক্তাররা।
বন্ডে সইও করে দেন বাবা। এরপর ডাঃ আচার্য-এর তত্ত্বাবধানে সল্টলেক থেকে শিশুটিকে নিয়ে আসা হয় মুকুন্দপুরের এক বেসরকারি হাসপাতালে। সেখানে এনআইসিইউ-তে অত্যাধুনিক পরিকাঠামোর সঙ্গে তৈরি করা হয় বিশেষ পরিবেশ তথা ইনকিউবেটর। কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্রও তৈরি করা হয়। এর মধ্যেই টানা দু মাস দশ দিন রাখা হয় শিশুকে। সৌম্যব্রতবাবু ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা-কে বলেন,"ফুসফুসকে পরিণত করার জন্য বিভিন্ন ওষুধ দেওয়া শুরু হয়। এরমধ্যে একটি সারফ্যাক্টট্যান্ট, যা টিউবের মধ্যে দিয়ে ফুসফুসে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছিল। ১৫-২০ দিন ভেন্টিলেশনেও রাখা হয়। এরপর সেখান থেকে বের করে অক্সিজেনের মধ্যে রাখা হয়। কিছুদিন পর সেখান থেকেও বের করে সাধারণ পরিবেশের মধ্যে রাখা হয় ঋদ্ধিস্মিতকে"।
ডাক্তারবাবু আরও বলেন, "একইসঙ্গে চ্যালেঞ্জের বিষয় ছিল ওজন বাড়ানো। প্রথমে ওজন ছিল ৬৯০ গ্রাম। এরপর ওজন কমতে কমতে পৌঁছে যায় ৫৮০ গ্রামে। কিন্তু মুখে খাবার দেওয়ার কোনো অবস্থাই ছিল না। তখন ল্যাবোটারিতে প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, ফ্যাট জাতীয় দ্রব্য মিশ্রণ করে (টোটাল প্যারেন্টাল নিউট্রিশন) কৃত্রিম খাবার তৈরি করা হয়। এরপর ক্যাথেটার তৈরি করে তার মাধ্যমে নাভি থেকে হার্ট পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল সেই খাবার। এরকমভাবে একমাস চলার পর শিশুটির এক কেজি ওজন হয়। এই এক মাস বিরাট লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে ঋদ্ধিস্মিত"। এরমধ্যে ব্রেনের স্ক্যান করা হয়েছে বেশ কয়েক বার। তবে দেখা গিয়েছে, কোনো হ্যামারেজ নেই। চোখ ফুটতেও কোনো সমস্যা হয়নি। এরপর মায়ের বুকের দুধ নাকে লাগানো টিউবের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করানো শুরু হয়। আরও একমাস পর ওজন হয় ২ কেজি। এরপর শিশুটিকে মায়ের কোলে ফিরিয়ে দেওয়া হয় বলে জানান ডাক্তারবাবু। এখন সে সম্পূর্ণ সুস্থ। বর্তমানে ওজন ৪.১ কেজি। আর পাঁচটা শিশুর মতোই সাধারণ জীবনযাপন করতে সক্ষম ঋদ্ধিস্মিত।
মা ভাস্বতী বলেন, "বিশ্বাস করতে পারিনি ঋদ্ধিস্মিত কে নিয়ে কোনো দিনও বাড়ি ফিরতে পারব। জন্ম হওয়ার পর থেকেই ও হাসপাতালে ভর্তি। ৭২ দিন পর কোলে পেয়েছি ওকে। এখন সুস্থ সন্তানকে মানুষ করার স্বপ্ন দেখা শুরু করেছি, যা এতদিন থমকে ছিল।"