আশ্বিন মাস পড়তে না পড়তেই এক সময়ে শুরু হয়ে যেত কিছু পুরোহিতদের ব্যাগ গোছানোর তৎপরতা। তাঁদের মধ্যে অনেকেই আমেরিকা, জাপান ও মায়ানমার সহ বিভিন্ন দেশে পুজো করার জন্য যেতেন। বায়না পেতেন অনেক আগে থেকেই। করোনা মহামারী পরিস্থিতিকে আমুল বদলে দিয়েছে। করোনা আবহে পুরোহিতদের বিদেশ যাওয়া একপ্রকার বন্ধই। তাই বলে তো আর পুজো করা বন্ধ হবে না। তার জন্য কলকাতা পুরোহিত সমাজ গত বছর থেকেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন অনলাইনে পূজো করার বিষয়টি।
এক্ষেত্রে তাঁদের পুজোর উপাচারে কোনও সমস্যা হবে না বলে জানান পুরোহিতরা। তবে বাদ সেধেছিল করোনা। অনেক পুজো উদ্যোক্তারা গত বারের করোনা পরিস্থিতিতে পুজো করার ঝুঁকি নেননি। কোথাও আবার মেলেনি অনুমতি। এবারও সেই অনলাইনে পুজোর ধারা বজায় থাকছে। তবে এবারের করোনা পরিস্থিতি গত বছরের তুলনায় ভাল, তাই কোভিড প্রোটোকল মেনে বিদেশে কোথাও আবার সশরীরে দেখা মিলতে পারে পুরোহিতদের।
করোনা আতঙ্ক কাটিয়ে এবার দুর্গাপুজো হচ্ছে বিদেশে। ইতিমধ্যেই প্রতিমা পাড়ি দিয়েছে আমেরিকা, ইউরোপ অস্ট্রেলিয়া-সহ বেশ কয়েকটি দেশে। আর বিদেশের পুজোর সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবেই জড়িয়ে আছে কুমোরটুলির নাম। এখানে থেকেই দূর দেশে পাড়ি দিয়েছে দুর্গা প্রতিমা। করোনা কাটিয়ে বিদেশের ঠাকুরের অর্ডারে কুমোরটুলিতে এবার তাই খুশির হাওয়া। গর বছর অর্ডার সেভাবে না থাকায় মাথায় হাত পরেছিল শিল্পীদের। তৈরি প্রতিমাও সেভাবে বিক্রি হয়নি। তাই মায়ের কাছে শিল্পীদের একটাই প্রার্থনা, ‘পুজোটা যেন ঠিকমতো হয়’।
দুর্গাপুজোর বাকি আর মাত্র হাতে গোনা কয়েকটা দিন। পুজোর কাউন্টডাউন শুরু হয়ে গিয়েছে। চারিদিকেই এখন শুধুই পুজোর গন্ধ। আর বাঙালি যেখানেই সেখানেই হবে দুর্গাপুজো। বাদ সেধেছিল করোনা অতিমারি। গত বছরে করোনার বাড়বাড়ন্তে সেভাবে অনেক জায়গাতেই পুজো হয়নি। মন যেন ভারি হয়ে ছিল।
একটা বছরের অপেক্ষার পর আবারও আকাশ বাতাসে পুজোর গন্ধ। এবারের পরিস্থিতি গত বছরের তুলনায় অনেকটাই ভাল। করোনার প্রকোপ কমবেশি থাকলেও তাকে নিয়ন্ত্রণ করা গেছে, এসেছে টিকাও। মাস্ক এবং টিকাকরণ এই দুই অস্ত্রকে হাতে রেখেই বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তে এবার হচ্ছে দুর্গাপুজো। স্বভাবতই খুশি বিদেশে বসবাসকারী বাঙালিরা। জার্মানির বার্লিনে এখন পুজো পুজো গন্ধ। কুমোরটুলির শিল্পীর তৈরি দেবীপ্রতিমা আগেই পাড়ি দিয়েছে বার্লিনে। শুধু বার্লিন কেন? আমেরিকা, কানাডা, মায়ানামার সহ বিভিন্ন দেশেই পাড়ি দিয়েছে কুমোরটুলির প্রতিমা। তাই এবারে কুমোরটুলির ব্যস্ততা গত বারের থেকে প্রায় দ্বিগুণ।
হাতে গোনা চারদিনের পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে কিছু শ্রেণির মানুষের সারা বছরের রুজি রোজকার। মহারাস্ট্রের গনেশ পুজোর পর দুর্গাপুজোর মতো এত বড় মাপের ইন্ডাস্ট্রি ভূ-ভারতে নেই। লেন দেন বা টার্ন ওভারের পরিমাণ প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা। এর সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে জড়িয়ে রয়েছে কমবেশি ২৫ লক্ষ মানুষের রুজি রোজগার।
তার মধ্যে যেমন মৃৎশিল্পী আছেন, তেমনই আছেন থিম শিল্পী, ডেকরেটর, প্রতিমা বাহক, আলোক শিল্পী আরও অনেকে। তাই পুজো না হলে একটা বড়ো অংশের রুজিরুটি যে কোপ পড়বে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। গত বছর করোনা আবহে প্রতিমার সেভাবে অর্ডার আসেনি। দূর দুরান্ত থেকে যাও বা দুএকটা অর্ডার এসেছিল শেষ সময়ে পুজো বাতিলের কারণে সেই ঠাকুর মণ্ডপের বদলে ঠাই পেয়েছিল শিল্পীর স্টুডিওতেই।
এবারেও পূজোর ১০০ দিন বাকি থাকতেও অর্ডার সেভাবে না আসায় মাথায় হাত পড়েছিল কুমোরপাড়ার শিল্পীদের। কিন্তু পরিস্থিতি দ্রুত বদলাতে থাকে। করোনা প্রকোপ কমতেই একের পর এক অর্ডার আসতে থাকে বিদেশ থেকে। তাতেই আনন্দের আমেজ কুমোরটুলির শিল্পীদের।
প্রশান্ত পালের স্টুডিও ভর্তি শুধুই ফাইবারের দুর্গা। দেখেই বোঝা যায় বিদেশ পাঠানোর প্রতিমা। “সিঙ্গাপুরের ঠাকুর কিছু পরে গেলেও ক্ষতি নেই। কিন্তু আরও লং জার্নি যাদের ভেনেজুয়েলা, অস্ট্রেলিয়ায় তারা পাড়ি দিচ্ছেন এখনই,” জানালেন প্রশান্ত। প্রশান্ত পালের দুর্গা গতবার বিদেশে গিয়েছে ৪টে। এবার বেড়ে ৬টা। তার মধ্যে লন্ডন, ভেনেজুয়েলা, নেদারল্যান্ডস আছে। তার কথায়, “বাইরের দেশে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। তাই তাঁরা পুজোর কথা ভাবছেন”।
অন্যদিকে শিল্পী কৌশিক ঘোষ করোনা কালের আগের তার হাতের তৈরি ৪০ থেকে ৫০টা প্রতিমা পাড়ি দিত ইউরোপ, আমেরিকা সহ বিভিন্ন দেশেই। কিতু গত বছর করোনার প্রকোপ একধাক্কায় সব অঙ্ক বদলে দিয়েছে। সর্বসাকুল্যে গত বছর ১০টা মতো প্রতিমা বিদেশে পাড়ি দিয়েছিল। এবার তাই পুজো আসতেই আশঙ্কার কালো মেঘ যেন ঘিরে রেখেছিল তাকে এবং তার সঙ্গে কুমোরপাড়ার অনান্য শিল্পীদেরও। তবে এবার তার সেই সংখ্যা প্রায় দ্বিগুনে পৌঁছেছে। স্বভাবতই উৎসবের চেনা ছন্দে কুমোরটুলি।
কেমন হয় বিদেশের প্রতিমা? উত্তরে এক শিল্পী জানান, মুলত ফাইবার দিয়েই তৈরি হয় এই প্রতিমা। বিদেশে পাঁচ থেকে ছয় ফুটের ঠাকুরের চাহিদা থাকে বেশি। তবে অনেক জায়গাতে তিন থেকে চার ফুটের ঠাকুরও ডেলিভারি করা হয়। মোটামুটি এক থেকে দেড় লক্ষের মধ্যেই দাম থাকে এই ঠাকুরের। আর তিন থেকে চার ফুট ঠাকুর মেলে আশি থেকে পঁচাশি হাজারের মধ্যেই। এবার করোনা পরিস্থিতি আগের থেকে ভাল। বিদেশের অর্ডারও এসেছে, পরিস্থিতির উন্নতির ফলে গত বছরের বিক্রি না হওয়া ঠাকুরও এবারে বিক্রি হয়েছে।
অনেক বড় পুজো কমিটি গুলি বাজেটে অনেক কাটছাঁট করেছে। তবে করোনা বিধি মেনে পুজোটা হচ্ছেই। আর তাতেই অর্ডার এসেছে আগের বারের থেকে অনেক বেশি। রীতিমতো তিথি নক্ষত্র মেনে পুজোর আয়োজন হবে বার্লিনে। সেখানে তিরুপতি মন্দিরের আদলে তৈরি মণ্ডপে হবে দুর্গা পুজো। এখন থেকেই তাই সাজোসাজো রব। বার্লিনে এখন পুজোর আমেজ। প্রবাসী বাঙালিরা মেতে উঠেছেন পুজোর আয়োজনে। তাই গত বারের না পাওয়ার হতাশা কে কাটিয়ে উঠে ছন্দে ফিরেছে কুমোরটুলি। ফিরেছে সেই চেনা ব্যাস্ততাও। করোনা কাটিয়ে আবার দুর্গাপূজায় ফিরছে বিলেতে। গতবারের তুলনায় ভিন দেশে পাড়ি দেওয়া দুর্গার সংখ্যাও বেড়েছে। কুমোরটুলির শিল্পীর স্টুডিওতে তাই পুজোর আগেই পুজোর রেশ।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন