উৎসব আবহে দীর্ঘ দিন ঘরবন্দি থাকা মানুষজন হাঁসফাঁস অবস্থা থেকে মুক্তির খোঁজে, উৎসবের সম্পূর্ণ আনন্দ উপভোগ করতে কোনও খামতি রাখেনি। এবারের দুর্গাপুজোর আবহে দ্বিতীয়া থেকেই কলকাতার অলিগলি থেকে রাজপথ কার্যত দখলে ছিল সাধারণ মানুষের। পুজো শপিং থেকে শুরু করে মন্ডপে মন্ডপে মাস্কহীন মানুষের সংখ্যা ছিল চোখে পড়ার মতো। টিকার উপর ভর করে আমজনতার এমন বেপরোয়া মনোভাব দেখে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ থেকে শুরু করে তাবড় চিকিৎসকরা। কিন্তু তাতে কর্ণপাত করেননি অনেকেই। উৎসব শেষে ফের করোনার বাড়বাড়ন্ত অব্যাহত।
বাংলায় ঊর্ধ্বমুখী করোনা গ্রাফ। তবে কি করোনার তৃতীয় ঢেউ আসন্ন? করোনার তৃতীয় ঢেউ-এ সব থেকে চিন্তা শিশুদের নিয়ে এমন সতর্কবাণী আগেই মিলেছিল। করোনা কালে কতটা নিরাপদ আপনার সন্তান?
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলার জন্য কলম ধরলেন প্রখ্যাত শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ইন্দ্রনীল চৌধুরি।
২০২০-র জানুয়ারির একেবারে শেষ থেকে আজ, প্রায় দেড় বছর হয়ে গিয়েছে। করোনা কেড়ে নিয়েছে প্রায় সাড়ে চার কোটি প্রাণ। গত বছরের শুরুতে বিদেশে যখন করোনা সংক্রমণের খবর টিভি বা সংবাদপত্রে প্রকাশ হতে শুরু করল, আমরা ভেবেছিলাম ইউরোপ, আমেরিকার ভুগবে। আমরা বেঁচে যাব। কিন্তু তা হল না, করোনা থাবা বসাল আমাদের দেশেও। ফলস্বরূপ লকডাউন। এছাড়া কোন উপায়ও অবশ্য ছিল না। এর পর জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে ভারত, ইরান, ইতালি-এই তিনটি দেশে একসঙ্গে সংক্রমণ প্রবেশ করে। বাকিটা ইতিহাস। তবে মার্চ-এপ্রিল এমনকী মে-জুন পর্যন্তও আমরা ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি করোনার প্রভাব কতটা? ওই বছর মার্চে লকডাউন করা হয়েছিল বটে তবে, লকডাউনের সময়টাতেই অনেকটা দেরি হয়ে গিয়েছিল।
আমাদের দেশে লকডাউনটা যদি আর কয়েকটা মাস আগে হত তাহলে অনেকগুলো প্রাণ আমরা বাঁচাতে পারতাম। অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে আজও আমরা কত বেপরোয়া! বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে তো দু'মাস ধরে ভোট হল। এমনিতে সংক্রমণ নিজস্ব গতিতেই বাড়ছিল এর মাঝে আমরা খানিকটা আগুনে ওই জল না ঢেলে তেল ঢালার প্রক্রিয়া শুরু করে দিলাম।
দাউ দাউ করে বাড়তে শুরু করল! ভোট পরবর্তী সময়ে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে ছারখার হয়ে গিয়েছিল সমগ্র দেশ। সারা দেশে অক্সিজেন থেকে বেডের আকালের মুখে পড়ে কত তাজা প্রান চোখের সামনে হারিয়ে যেতে দেখেছিলাম। তারপর পরিস্থিতি অনেকটাই বাগে আসতে শুরু করে। উৎসব আবহে আবারও বেপরোয়া মানুষজন। টিকার একটি মাত্র ডোজের ওপর ভর করে রাস্তায় নেমে নিজেদের সঙ্গে নিজের প্রিয় সন্তানদের প্রাণ জলাঞ্জলি দিতে কাতারে কাতারে মানুষ পথে নামল।
একবারের জন্য তাঁরা ভাবল না কী পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে আমরা আজকের দিনে এক সন্তোষজনক পরিস্থিতিতে এসে দাঁড়িয়েছিলাম। টিকা এবং করোনা বিধির উপর ভর করে দেশে ধীরে ধীরে করোনা গ্রাফ নামতে শুরু করেছে। কিন্তু আমরা আর কটা দিন অপেক্ষা করতে পারলাম না।
নিজেদের সঙ্গে নিজেদের সন্তানদের জীবনকে বাজি রেখে আমরা ভরপুর আনন্দ উপভোগ করলাম। যার পরিণতি ভয়ঙ্কর হতে পারে বারংবার সেই সব সাবধানবাণীকে উপেক্ষা করে আমরা আনন্দের জোয়ারে গা ভাসালাম। পুজো শেষেই ফের ঊর্ধ্বমুখী করোনা গ্রাফ। এই পরিস্তিতিতে সব থেকে চিন্তা শিশুদের নিয়ে।
বড়দের এমন বেপরোয়া মনোভাব অচিরেই বিপদ ডেকে আনতে পারে শিশুদের ক্ষেত্রে। বেশ কয়েকটা মাস আপনার শিশুদের নিরাপদে রাখুন। এই বিষয়ে বেশ কিছু দায়িত্ব অভিভাবকদের নিতে হবে। ভরসা রাখুন চিকিৎসকের উপর। করোনাসুরকে হারিয়ে একটা সুন্দর আগামী আপনাদের উপহার দিতে আমরা চিকিৎসকরা আপনাদের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। শিশুদের প্রতি আরও যত্নবান হোন, দূরে থাকুক করোনা। নীচের কয়েকটি বিষয় মেনে চলুন।
● শিশুর খেলনার জিনিসগুলি প্রতিদিন পরিষ্কার করে নিন। শিশুকে যতটা পারবেন হালকা গরম জলে স্নান করান।
● ভিড় থেকে শিশুদের দূরে রাখুন। মাস্ক পরিয়ে রাখুন ২ বছরের উপরে সকল শিশুদের।
● আপনার সন্তানদের জামাকাপড় নিয়মিত সাবান দিয়ে পরিষ্কার করুন।
● বাইরের খাবার থেকে বাচ্চাদের দূরে রাখুন।
● জ্বর দমকা কাশি হলে তৎক্ষণাৎ ডাক্তারবাবুর পরামর্শ নিন।
● শিশুদের বেশি করে জল খাওয়ান। দিনে খাবারের তালিকায় ফল যেন বাদ না পড়ে সেদিকে নজর রাখুন।
● ঠান্ডা জল, আইসক্রিম থেকে এই সময়টা যতটা পারবেন দূরে রাখুন। বাচ্চা কাঁদলেও দেবেন না। বাচ্চার সামনে থেকে যতটা পারবেন দূরে রাখুন।
● ঘরের যেসব স্থান আপনার সন্তান বারবার স্পর্শ করা হয়, তা জীবাণুমুক্ত রাখুন।
● বাইরে থেকে এসে শিশুদের আদর বা স্পর্শ করবেন না। ঠোঁটে ঠোঁট দিয়ে আদর করবেন না।
● যেহেতু বাচ্চারা উপসর্গহীন হয়ে থাকে তাই তাদের দিকে ভাল ভাবে নজর রাখুন।
● আপনার বাচ্চার মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে নজর দিন। তাদের সময় দিন।
● ১২ বছরের ঊর্ধ্বে যাদের কোমর্বিডিটি রয়েছে, করোনার টিকার ব্যাপারে সরকারি নিয়ম মেনে চলুন।
● ভরসা রাখুন ডাক্তারবাবুদের উপর। আপনার স্যানিটাইজড হাত এগিয়ে দিন আপনার ডাক্তারবাবুর দিকে। প্যানিক না করে বিজ্ঞানের উপর ভরসা রাখুন। করোনাসুরকে হারিয়ে একটা সুন্দর আগামী আপনাদের উপহার দিতে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন