একটাও বায়না নেই, কুমোরটুলিতে হাহাকার

"সমস্যা ঠিক কতটা সেটা বলার জন্য ভাষা পাচ্ছি না। চিত্কার করে কাঁদতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু কেঁদেই বা কী হবে? ভবিষ্যতে কোথায় গিয়ে দাঁড়ব, কারও কাছে কোনো উত্তর নেই"।

"সমস্যা ঠিক কতটা সেটা বলার জন্য ভাষা পাচ্ছি না। চিত্কার করে কাঁদতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু কেঁদেই বা কী হবে? ভবিষ্যতে কোথায় গিয়ে দাঁড়ব, কারও কাছে কোনো উত্তর নেই"।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

ছবি- শশী ঘোষ

করোনার কামড় কুমোরটুলিতেও। চিন্তায় রাতের ঘুম উড়েছে পটুয়াপাড়ার মৃৎশিল্পীদের। একটিও বায়না আসেনি। আসলে ২৫ শে বৈশাখের মধ্যেই কুমোরটুলির মৃৎশিল্পীরা বুঝে যান এবছর তাদের ঠিক কটা প্রতিমা বানাতে হবে। বড় পুজোর অর্ডার অক্ষয় তৃতীয়াতেই এসে যায় কুমোরটুলিতে। শিল্পী মিন্টু পাল বলেন, "ঠাকুরের অর্ডার কেউ দেয়নি বৈশাখে। এখন কেউ আসছে না। আদৌ পুজো করবে কিনা, তা নিয়েও বেশ কিছু ক্লাবের অনিশ্চিয়তা রয়েছে। করোনা কুমোরটুলির শিল্পীদের পেটের ভাত কেড়ে নিয়েছে"।

Advertisment

তবু অপেক্ষা করছেন কমোরটুলির শিল্পীরা। শুধু তো দূর্গা পুজোই নয়, বাংলা ক্যালেন্ডার বলছে সামনেই গণেশ ও বিশ্বকর্মা পুজো। মিন্টু পাল বলেন, "বছরের ঠিক যে সময় থেকে আমাদের রোজগার শুরু হয়, সেই সময়তেই জারি হয়েছে লকডাউন। তাই গণেশ ও বিশ্বকর্মা পুজোর ঠাকুরগুলোও তৈরি করা সম্ভব হবে কিনা বুঝতে পারছি না। কারণ, ঠাকুর তৈরি করা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। এর উপর বর্ষায় বৃষ্টির জ্বালা তো আছেই। চৈত্র, বৈশাখ ও জৈষ্ঠ্য মাসে বেশ কিছু পাড়ায় ও বাড়িতে শেতলা পুজো হয়, পয়লা বৈশাখ ও অক্ষয়তৃতীয়ার জন্য যে লক্ষ্মী গণেশ কেনার ধুম পড়ে, এ বছর সেই ব্যবসাও পুরো বন্ধ ছিল, কোনো রোজগারেই হয়নি।" তিনি আরও বলেন, "করোনার জেরে বিদেশ থেকে পর্যন্ত কোনো অর্ডার আসেনি। পশ্চিমবঙ্গের দূর্গাৎসব যে কী হতে চলেছে তা জানি না! ক্লাবগুলির সঙ্গে যোগাযোগ করেছি, তারা বলেছেন 'পুজো হবে, কিন্তু নম নম করে, থিম হবে না"।

publive-image ছবি- শশী ঘোষ

Advertisment

কুমোরটুলির আরেক মৃৎশিল্পী অপু পাল বলেন, "আমাদের কিছু কিছু তারিখ থাকে, যেদিন আমরা মূলত ঠাকুরের বায়না পাই। অক্ষয় তৃতীয়া থেকে শুরু করে বৈশাখ মাস ধরে অর্ডার আসতে থাকে। এরপর রথে মূলত সবচেয়ে বেশি অর্ডার আসে। লকডাউনের কারণে, গোটা বৈশাখ মাস শেষ হতে চলেছে, একটাও অর্ডার আসেনি কুমোরটুলিতে। প্রতিবছর মোটামুটি প্রায় ৪১ থেকে ৪৫ টা প্রতিমা তৈরি করি। যার মধ্যে ৩০ টা আমার পুরানো বায়নাদার। তারা প্রত্যেকবছরই অর্ডার দেন। সেই মতো ঠাকুর বানানোর প্রস্তুতি নিতে থাকি। কিন্তু এবছর কিছুই শুরু হয়নি। পুরানো বায়নাদাররাও বুঝে উঠতে পারছেন না, আদৌ তারা পুজো করবেন কিনা!"

দূর্গাপুজোর ১৫ দিনের মাথায় থাকে কালি পুজো। তাই সে সময় প্রতিমা বানানো সম্ভব নয়। তাই বৈশাখ জৈষ্ঠ্যেতেই শুরু হয়ে যায় কালি ঠাকুর বানানোর পালা। অপুবাবু বলেন, “করোনার থাবা যে শুধু দূর্গা পুজোয় পড়েছে তা নয়, কালি পুজোর ব্যবসাকেও মাটি করে দেবে। কারণ, এখন কারিগর নেই, তারা যে যার বাড়িতে, কোনো কাজ হচ্ছে না। মাল নেই। তাই এখনও কুমোরটুলির কেউ কালি ঠাকুর তৈরি করতে পারল না। লকডাউন উঠলেও সমস্যা মিটবে না বলেই মনে হচ্ছে। বাজারে মাল নেই। যারা ঠাকুর নেবে তারা কত ফুটের ঠাকুর নেবে তাও বোঝা যাচ্ছে না। সবাই মোটের উপর জানিয়েছেন, বাজেট কম হবে। কারণ,স্পনসর বা বিজ্ঞাপন নেই। শুধুমাত্র চাঁদার টাকায় তো আর থিমের বড় পুজো হয় না!" তিনি আরও বলেন, "ঠাকুর তৈরির সঙ্গে জুড়ে আছে একাধিক মানুষের জীবন, রুটি রোজগার ও একাধিক ব্যবসা। প্রতিমার চুল, গহনা, শাড়ি, রঙ, চালচ্চিত্র বানানো আরও কত কী। সে সমস্তটাই বন্ধ। জানতে পেরেছি, সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে গহনা ও শাড়ি তৈরি। তাই লকডাউন উঠলেই যে আমি মাল কিনে ঠাকুর তৈরি করতে পারব, এমনটা একেবারেই নয়"।

publive-image ছবি- শশী ঘোষ

কুমোরটুলির শিল্পীরা জানাচ্ছেন, নদীয়া, মুর্শিদাবাদ, বর্ধমানের কাটোয়া, বিভিন্ন জেলা থেকে ঠাকুর বানাতে, গয়না, চালচ্চিত্র তৈরি করতে কলকাতার কুমোরটুলিতে আসেন শিল্পীরা। সুরাট ও আমেদাবাদ থেকে আসে প্রতিমার কাপড়, পার ও জড়ি। এই সমস্তটাই এখন থমকে গিয়েছে। ঠাকুরের চুল তৈরি করেন মূলত মুসলমানরা। সেটি আমতলা থেকে আসে। এই বৈশাখের প্রখর রোদকে তাঁরা কাজে লাগায়। চুল তৈরি করার জন্য আদর্শ সময় এখন। এরপর চুল তৈরি করতে গেলে তা নরম হয়ে যায়। কিন্তু সেই কাজও বন্ধ রয়েছে।

মৃৎশিল্পী মিনাক্ষী পাল ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা-কে বলেন, "এটাই আমাদের রুটি রোজগার। সারা বছর এই রোজগারের উপর ভর করেই পেট চলে। কিন্তু সেটাই বন্ধ। কারিগররা মুখের দিকে চেয়ে আছে। কিন্তু কাজ না থাকলে তাদের আমি কীভাবে সাহায্য করব? স্বামী অসুস্থ, ছেলের পড়াশুনা চলছে, কী করে জোগার করব সবটা? সমস্যা ঠিক কতটা সেটা বলার জন্য ভাষা পাচ্ছি না। চিত্কার করে কাঁদতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু কেঁদেই বা কী হবে? ভবিষ্যতে কোথায় গিয়ে দাঁড়ব, কারও কাছে কোনো উত্তর নেই। কারিগররা হত দরিদ্র, তাদের কথা ভাবলেই ভয় লাগছে। তাদেরও সংসার আছে। নামীদামি মৃত্শিল্পীরা তাও চালিয়ে নিতে পারবেন। কিন্তু যাঁরা নিম্নমধ্যবিত্ত, যাঁদের ব্যবসা ছোট? তাঁরা কেঁদে কুল পাচ্ছেন না। বৈশাখ মাসে আমরা বুঝে যাই, ঠিক কটা ঠাকুর বানাব এ বছর, যা অর্ডার আসে সেই টাকা দিয়ে মাল কিনে ফেলি। এ বছর সবটা বন্ধ। ঠাকুর আজ বললে কাল তৈরি হয়ে যাবে এমনটা নয়। ঠাকুর তৈরি করতে সময় লাগে। রথে বাকি বায়না পাই। কিন্তু সেটা সর্বশেষ। আপাতত, সেই দিকেই তাকিয়ে আছি। কিন্তু, লকডাউন উঠলে মাল পাবো না। মাল পেতে দেরি হলে ঠাকুর বানাতেও দেরি হবে। তার উপর বৃষ্টির চাপতো আছেই। আমি কুমোরটুলি মৃৎশিল্প সাংস্কৃতিক সমিতির সম্পাদক বাবু দাকে (বাবু পাল) বলেছি, বিধায়ককে জানাতে, যদি কিছু সহায়তা করে সরকার!"

publive-image ছবি- শশী ঘোষ

বিধায়ক তথা মন্ত্রী শশী পাঁজা ‘দুঃখ সঙ্গে’ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলাকে বলেন, "আমি কী করব? এখন, আমার হাতে কিছু নেই। আমি কিছু ক্লাবকে বলেছি পুজো করতে। তারা পুজো করলে মৃৎশিল্পীরা একটু স্বস্তি পাবে। কিন্তু, এটি সম্পূর্ণ কুমোরটুলির ব্যক্তিগত ব্যবসা। এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারি না। কিন্তু তা সত্ত্বেও, ওঁদের অসুবিধার বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে দেখা হচ্ছে। আমি বলেছি মৃৎশিল্পীদের, তোমরা কারিগরদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখো। এতে তারা মানসিক দিক থেকে একটা ভরসা পাবে।

অন্যদিকে লকডাউন ওঠার অপেক্ষায় রয়েছে আদিত্য মল্লিক লেন। কলকাতার চালচিত্রের পীঠস্থান। আগামী মাসের মধ্যেই তাদের কাছে আসাম থেকে সহস্র গোছা বাঁশ এসে পৌঁছানোর কথা। যা না এলে, তাদের কোনও কাজই হবে না। শিল্পী রাধাকান্ত বড়াল দুঃখ করে বলেন, "থিম পুজোর ইঁদুর দৌড়ে হারিয়েছে সাবেকি পুজোর আধিপত্য। ব্যবসায় এসেছে ভাঁটার টান। এর উপর আবার করোনা ভাইরাসের গুঁতো। অনেকেই বলছে পুজো করবে না। পুজো না হলে চালচ্চিত্রও কেউ কিনবে না। তাই, বাঁশ কত কিনব বুঝে উঠতে পারছি না"।

এত কিছুর পরও লকডাউন ওঠার অপেক্ষা করছে কুমোরটুলি। যদি শেষমেশ মোটামুটি একটা ব্যবস্থা হয়! এই মাটি থেকেই রূপ গ্রহণ করেন ঈশ্বর, তিনি কি একটিবার এই মাটির কথা ভাববেন না!

kolkata news