কুমোরটুলিতে প্রতিমা নির্মাণের ইতিহাস ২৫০ বছরেরও বেশি। এখানে প্রায় ১৭৫ জন মৃৎশিল্পী রয়েছেন, তাঁদের মধ্যে হাতে গোনা কয়েকজন মহিলা। আর্থিক ও সামাজিক চ্যালেঞ্জ ছাড়াও মহিলা হিসেবে তাঁদের অতিরিক্ত সমস্যার মুখেও পড়তে হচ্ছে।
Advertisment
কুমারটুলির মৃৎশিল্পে মহিলারা
চায়না পাল যখন বাবার প্রতিমার দোকানের দায়িত্ব নেন, সে দু দশক আগের কথা। ৪৭ বছরের চায়না পাল শুধু পুরুষ মৃৎশিল্পীদের কাছ থেকে বিরোধিতার সম্মুখীন হননি, বাবার দোকানের অন্য কারিগররাও মহিলার অধীনে কাজ করতে রাজি হননি।
কুমোরটুলিতে জায়গার সংকীর্ণতার জন্য ফুটপাথে এবং দোকানের বাইরে প্রতিমা রাখতে বাধ্য হন। চায়না পাল বলছিলেন, "পুরুষরা আমার দোকানের বাইরে জিনিসপত্র রাখা নিয়ে ঝামেলা করতে শুরু করেন। ওঁরা নিজেরাও কিন্তু তাই করতেন। কখনও কখনও আমার চোখে জল এসে যেত কিন্তু আমি মুখ বন্ধ করে আমার কাজ করে যেতাম। এখন আমি ওদের আর ভয় পাই না।" পুরুষ মৃৎশিল্পীরা তাঁদের প্রশ্ন করতেন, পুরুষের সাহায্য ও দেখভাল ছাড়া একজন মহিলা কী করে এ কাজ চালাবেন।
কুমোরটুলির এক তস্য গলিতে কাজ করেন মালা পাল এবং কাকলি পাল। তাঁদের মধ্যে আত্মীয়তা নেই কোনও। একই গলির দুই ওয়ার্কশপে কাজ করা ছাড়া। মালার কারখানা ছিল তাঁর বাবার। আমার বাবাও বলতেন, "এ ছেলেদের পেশা, মেয়েদের নয়। মেয়েরা কেন দোকানে আসবে? আমি অবশ্য তাঁর কথা শুনিনি।"
Advertisment
মালার এক দাদা ছিলেন, যিনি বোনের প্রতিভা চিনতে পেরেছিলেন এবং এ কাজে তাঁকে উৎসাহ দিয়ে গিয়েছেন। বাবার মৃত্যুর পর ৬ ভাইবোনের সংসারে টানাটানি ছিল খুব। কখনও কখনও দিনে একবার খাওয়া জুটত তাঁদের। বাবা মারা যাবার পর দাদা ঠাকুর বানানোর সঙ্গে অন্য একটা কাজও নেয়। আমার যখন ১৪ বছর বয়স আমি তখন থেকে দোকান যেতে শুরু করি। প্রতিমার অর্ডারও বাড়তে থাকে, টাকার টানাটানিও কমে। এখন আমি জার্মানি ও লন্ডনের খদ্দেরদের কাছে প্রতিমা পাঠাই।
দুনিয়া ভর স্বীকৃতি
গত বছর মালা পালের কাছেই দুর্গা প্রতিমার অর্ডার দিয়েছিলেন কলেজ ছাত্র শুভমিত লাহা। তিনি বললেন, "আমি কুমোরটুলির অন্য মহিলা মৃৎশিল্পীদের কথা শুনেছি, কিন্তু ওঁর প্রতিমাই সেরা।"
মালা পালের কারখানা (ছবি- নেহা বাঁকা)
৪১ বছরের কাকলি পাল প্রতিমা বানাচ্ছেন ১৬ বছর ধরে। তিনি এ পেশায় ঢুকেছিলেন আর্থিক কারণে। "আমার স্বামী হঠাৎ ব্রেন স্ট্রোকে মারা যান, ফলে আমাকে ব্যবসায়ে ঢুকতে হয়। আমি এ ব্যাপারে কিছু জানতাম না। ধীরে ধীরে শিখে নিই।" এখন কাকলির কারখানায় আর দু-তিন জন সহকারী রয়েছেন, যাঁদের সঙ্গে নিয়ে তিনি প্রতিমা বানান।
১৬ বছর আগে স্বামী যখন মারা যান তখন কাকলির ছোট মেয়েক বয়স ছিল ১ বছর। মেয়েকে পাশের বাড়িতে রেখে কারখানায় যেতেন তিনি। মাথার উপর পুরুষ অভিভাবক ছিল না বলে অনেকেই তখন সুযোগ নিতে চাইত বলে জানিয়েছেন তিনি।
কুমোরটুলির সামাজিক বিপত্তি
মহিলা মৃৎশিল্পীদের নিয়ে ধারণা এবং অভ্যাস বদলাচ্ছে, ধীরে হলেও। চায়না বলছিলেন, "একসময়ে এমন লোকজন ছিলেন যাঁরা মহিলা মৃৎশিল্পী হবার কারণে আমাদের ঈর্ষা করত।" তার কারণ তিনি একা হাতে এত কিছু সামলাতেন বলেও, এবং স্বামীর মৃত্যুর পর ব্যবসা বাড়িয়ে নিয়ে যাবার কারণে।
যতই তাঁদের রোজগারে সংসার চলুক না কেন, বাড়ির নিত্য দিনের কাজ এখনও তাঁদের নিজের হাতেই করতে হয়। চায়না জানালেন, "আমি বাড়ির ও দোকানের সব কাজ করি। রান্না থেকে মুদীর বাজার, প্রতিমার রং কেনা, সবই নিজের হাতে। কে সাহায্য করবে! কেউ কিছু করে দেয় না। যা করার আমাকেই করতে হয়। যতদিন বেঁচে থাকব, করে যাব। যদি তার জন্য লড়াই করতে হয়, তাও করব।"
বড় প্রতিমা নির্মাণকাজে চায়না পালের সহযোগী শিল্পীরা
কারখানার পাশেই একটা ঘরে থাকেন কারিগররা। কারও কারখানায় ঘরের ব্যবস্থা নেই, একটা ত্রিপল কাটিয়ে কারখানার মধ্যেই সুয়ে পড়েন। অনেকে আবার সপরিবারে থাকেন কুমোরটুলির কোনও তস্য গলিতে। এতে যাতায়াতের সময় বাঁচে, এই দুর্গাপুজোর সময়টাতে। বিকেলের দিকে খদ্দের যখন কম, তখন কারখানার মধ্যেই মাদুর পেতে শুয়ে পড়েন।
কে প্রথম মহিলা মৃৎশিল্পী
মালা পালের ভাই গোবিন্দ পাল (৫৬) মনে করেন, "কামাখ্যা পাল ছিলেন কুমোরটুলির প্রথম মহিলা মৃৎশিল্পী। কয়েক বছর আগে তিনি মারা গিয়েছেন। গোবিন্দ বলছিলেন, কামাখ্যার বেঁচে থাকা নির্ভর করত শুধু প্রতিমা বানানোর উপরেই। ফলে তাঁকে কেউ কিছু বলতে কোনওদিন সাহস পায়নি। সবাই জানত প্রতিমা না বানালে ওঁর খাওয়াপরা জুটবে না।"
মেয়েরা কেন এ পেশায় আসতে পারবে না, সে নিয়ে প্রশ্ন করতেন কামাখ্যা পাল, বললেন গোবিন্দ। "এখন কত কী ঘটছে। মেয়েরা ফুটবল-ক্রিকেট খেলছে। কিন্তু ১৯৮৫ সালে মেয়েরা এ পেশায় আসার কথা ভাবতেই পারত না।" কামাখ্যা চাইতেন মেয়েরা তাঁর দোকানে আসুক।
বহুদূর হেঁটে এসে
দু দশক হয়ে গেল চায়না পালের কাজ শুরুর পর। তখন তাঁকে কেউ চিনত না। ২০১১ সালে আমি কোনওদিন যা ভাবিনি তাই হলষ আমি রাজ্যপালের কাছ থেকে পুরস্কার পেলাম। ২০১৮ সালে সরকার কুমোরটুলির মহিলা মৃৎশিল্পী হিসেবে আমাকে চিনে পাঠায়। তাঁর কাজ নজরে পড়েছিল কলকাতায় চিনের কনসুলেট জেনারেলের। সে সময়ে ওঁর পাসপোর্ট ছিল না। ফলে তাড়াহুড়ো করে কোনওরকমে পাসপোর্ট পাবার পর চিনের কুনমিংয়ে যেতে পারেন তিনি।
এক বর্ষণমুখর বিকেলে মাটিতে বসে প্রতিমার মুখে হলুদ রং লাগাচ্ছিলেন চায়না। মাথার উপর একটা ছোট পাখা ঘুরছে। "বাংলায় একটা কথা আছে না, ফল দেখলে গাছ চেনা যায়। তেমনভাবেই শুধু কাজ দেখে একদিন মহিলা মৃৎশিল্পী চেনা যাবে।" মুখ না তুলেই বললে চায়না।