Advertisment

Premium: শহর কলকাতায় ছড়িয়ে আছে খ্রিস্টান সম্প্রদায়, তাঁদের উপাসনালয়গুলোর ইতিহাস জানলে চমকে উঠবেন

Churches of Kolkata: বড়দিন থেকে ইংরেজি নতুন বছর, কলকাতার পথে শহরবাসীর ঢল নামে। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের উপাসনাগৃহে ভিড় জমান এই শহরের মানুষ।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Kolkata City

Kolkata City: নানা ধর্ম ও বর্ণের মিলনে কলকাতার চরিত্র বর্ণময়। (ছবি: কলকাতা পুলিশ)

আমাদের প্রিয় শহর কলকাতা। যে শহরে রয়েছে বিভিন্ন ধর্মের উপাসনালয়। তারই অন্যতম খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের উপাসনাগৃহ। বড়দিন থেকে ইংরেজি নতুন বছর, কলকাতার পথে শহরবাসীর ঢল নামে। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের উপাসনাগৃহে ভিড় জমান এই শহরের মানুষ। কিন্তু, আমরা ক'জন সেই সব উপাসনালয়ের ইতিহাস জানি? চলুন, তারই কয়েকটির রোমাঞ্চকর ইতিহাস দেখে নেওয়া যাক।

Advertisment
St Paul’s Cathedral, Kolkata
St Paul’s Cathedral-Kolkata: ১৮৪৭ সালে নির্মাণ শেষ হয় ক্যাথিড্রালের। (ছবি: কলকাতা পুলিশ)

সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল

১৮১৯ সালে একটি ক্যাথিড্রাল (বড় পরিসরের গির্জা) বানানোর উদ্দেশ্যে ডিজাইন দেখতে চান বাংলার তৎকালীন গভর্নর-জেনারেল ফ্রান্সিস হেস্টিংস। কিন্তু দেখা যায়, বিলাসবহুল সেই নীল নকশাকে বাস্তবে পরিণত করতে হলে যে পরিমাণ খরচ হবে, তা বহন করা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পক্ষে সম্ভব নয়। তাছাড়া, ক্যাথিড্রালের জন্য যে জায়গা নির্দেশ করেন তৎকালীন বিশপ মিডলটন, তা যেন বড্ড বেশি দক্ষিণে। মজার কথা হল, পরে কিন্তু সেখানেই গড়ে ওঠে সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল। আরও মজার ব্যাপার হল, ১৭৬২ সালের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নথিপত্র থেকে জানা যায়, এই এলাকায় তখন ঘন জঙ্গল ছিল। অবাধে ঘুরে বেড়াত বাঘ। তবে ১৮৩২ সালে যখন ক্যাথিড্রালের প্রসঙ্গ আবার একবার উঠে আসে, তখন আর বাঘের চিহ্ন ছিল না। শেষমেশ ১৮৪৭ সালে নির্মাণ শেষ হয় ক্যাথিড্রালের। খরচ পড়ে সেই যুগের হিসেবে প্রায় ৪.৩৫ লক্ষ টাকা।

St Andrew’s Church, Armenian Church
St Andrew’s Church-Armenian Church: সেন্ট অ্যানড্রুজ গির্জা (বামদিকে) এবং আর্মেনিয়ান গির্জা (ডানদিকে)। (ছবি: কলকাতা পুলিশ)

সেন্ট অ্যানড্রুজ গির্জা

কলকাতা পুলিশের সদর দফতর লালবাজার থেকে কয়েকশো মিটার দূরত্বে অবস্থিত সেন্ট অ্যানড্রুজ গির্জা। তবে তার আগে ওই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিল ওল্ড কোর্ট হাউজ। যেটির ভগ্নদশা দেখা দেওয়ায় ভেঙে ফেলা হয় ১৭৯২ সালে। এই আদালতেই ১৭৭৫ সালে বিচার এবং ফাঁসির আদেশ হয় মহারাজা নন্দকুমারের। সে যুগের বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য মামলার মধ্যে নিঃসন্দেহে সবচেয়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী ছিল এই মামলা। আজকের ওল্ড কোর্ট হাউজ স্ট্রিট সেই যুগেরই স্মৃতিচিহ্ন। খুব সোজাভাবে বলতে গেলে, স্কটিশ প্রেসবিটারিয়ান মতাবলম্বীদের জন্য তৈরি এই গির্জা। পাদ্রি ছিলেন রেভারেন্ড জেমস ব্রাইস। কলকাতার মাটিতে ১৮১৪ সালে পা রাখার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তিনি বিবাদে জড়িয়ে পড়েন কলকাতার প্রথম বিশপ ফ্যানশ মিডলটন-এর সঙ্গে। মিডলটন ছিলেন চার্চ অফ ইংল্যান্ডের প্রতিনিধি, তথা সেন্ট জনস গির্জার প্রধান। দুই পাদ্রির বিবাদ চরমে ওঠে নির্মীয়মাণ সেন্ট অ্যানড্রুজ-এর শিখরকে কেন্দ্র করে। সেন্ট জনস গির্জা তো আর নতুন করে তৈরি করা যাবে না, সুতরাং মিডলটন-এর দাবি ছিল, নতুন গির্জার শিখর সেন্ট জনস-এর শিখরের চেয়ে উচ্চতায় খাটো হতে হবে। চার্চ অফ ইংল্যান্ডের অধীনস্থ ধর্মস্থানের চেয়ে উঁচু চূড়া হবে নতুন গির্জার? অসম্ভব! এদিকে ব্রাইস-এর ধমনিতে বইছে বিদ্রোহী স্কটিশ রক্ত। অতএব তিনি শিখর তো খাটো করলেনই না। বরং স্রেফ মিডলটনকে আরও চটিয়ে দিতে শিখরের ওপর বসালেন হাওয়া মোরগ। রাগে আগুন মিডলটন-কে শান্ত করতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রশাসনকে এবার কথা দিতে হল, নতুন গির্জার বাকিটা দেখভাল করবে শহরের পূর্ত বিভাগ। কিন্তু, হাওয়া মোরগকে ছোঁবে না পর্যন্ত! এবং এই নিয়মই বহাল রইল ১৮১৮ সালে গির্জা উদ্বোধন হওয়ার দিন থেকে।

St John’s Church, Kolkata
St John’s Church-Kolkata: জন্মলগ্নে আজকের রাজভবনের খুব কাছে অবস্থিত এই গির্জা ছিল ক্যাথিড্রাল। (ছবি: কলকাতা পুলিশ)

সেন্ট জনস গির্জা

জন্মলগ্নে আজকের রাজভবনের খুব কাছে অবস্থিত এই গির্জা ছিল ক্যাথিড্রাল। ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী হয়ে ওঠার পর কলকাতায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তৈরি প্রথম সর্বজনীন ভবন। সেন্ট পলস তৈরি না-হওয়া অবধি সেন্ট জনস-ই ছিল কলকাতার একমাত্র অ্যাংলিকান ক্যাথিড্রাল। ১৭৮৭ সালে নির্মিত এই গির্জা কলকাতার তৃতীয় প্রাচীনতম খ্রিস্টান উপাসনাগৃহ। এর সংলগ্ন জমিতে রয়েছে পুরোনো কলকাতার কিছু অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বের সমাধি এবং স্মৃতিসৌধ। যাঁদের মধ্যে রয়েছেন স্বয়ং জোব চার্নক, লেডি ক্যানিং, এবং ‘বেগম’ ফ্রান্সেস জনসন (যাঁর স্বামী উইলিয়াম জনসন ছিলেন এই গির্জার পাদ্রি)। মূল ভবনের আশপাশে আরও রয়েছে লর্ড কার্জন নির্মিত ‘ব্ল্যাক হোল অফ ক্যালকাটা’ স্মৃতিসৌধ। দ্বিতীয় রোহিলা যুদ্ধে নিহত ব্রিটিশ সৈনিকদের স্মৃতিসৌধ।

আর্মেনিয়ান গির্জা

এই অঞ্চলে ব্রিটিশদের আগমনের বহু আগেই আবির্ভাব ঘটে আর্মেনিয়ান সম্প্রদায়ের। ভারতে বসবাসকারী আর্মেনিয়ানদের সঙ্গে ১৬৮৮ সালে চুক্তিবদ্ধ হয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। চুক্তির একটি শর্ত হয়, ৪০ বা তার বেশি সংখ্যক আর্মেনিয়ান কোনও এলাকায় বসবাস করলে সেখানে কোম্পানিই তৈরি করে দেবে তাঁদের উপাসনা ঘর। পুরনো কলকাতার ভাষায় ‘আর্মানি গির্জা’ ১৭০৭ সালে আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়ার পর ১৭২৪ সালে অর্থ সংগ্রহ করে নতুন গির্জা নির্মাণ করেন ইয়াকব নাজার। আজ যে বাড়িটি আমরা দেখি, সেটি ১৭৬৪ সালে নির্মাণ করেন আগা মামেদ হাজার মালিয়ার। জমি দিয়েছিলেন আরেক আর্মেনিয়ান, নাম কেনানেনটেখ ফানুশ। কলকাতার প্রাচীনতম গির্জার দামী আসবাবে সজ্জিত অভ্যন্তর, সাদাকালো মার্বেলের মেঝে ইত্যাদির খরচ যোগান স্যার ক্যাচিক পল চেটার-এর মতো বিত্তশালী আর্মেনিয়ান নাগরিকবৃন্দ। বাইরের খরচ আসে আরও কিছু ধনবান আর্মেনিয়ানদের কাছ থেকে। যাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন অ্যারাটুন স্টিফেন। এই অ্যারাটুন স্টিফেন হলেন, সে যুগের বিশ্ববিখ্যাত গ্র্যান্ড হোটেল (আমাদের কাছে ওবেরয় গ্র্যান্ড)-এর নির্মাতা তথা মালিক।

Portuguese Church, Kolkata
Portuguese Church, Kolkata: পোশাকি নাম ক্যাথিড্রাল অফ দ্য মোস্ট হোলি রোজারি। (ছবি: কলকাতা পুলিশ)

পর্তুগিজ গির্জা

কলকাতার একমাত্র অবশিষ্ট পর্তুগিজ গির্জার পোশাকি নাম ক্যাথিড্রাল অফ দ্য মোস্ট হোলি রোজারি। পত্তন ১৭৯৯ সালে। যা আমাদের মনে করিয়ে দেয় পুরোনো কলকাতার বিশ্বজনীন চরিত্রের কথা। এ-ও মনে করিয়ে দেয় যে বাংলায় পর্তুগিজ বণিকশ্রেণি প্রথম এসেছিলেন ১৫৩০-এর দশকে। ব্রিটিশদের আগমনের ১৫০ বছরেরও বেশি আগে। তাঁদের ঘাঁটি ছিল ব্যান্ডেলে। তারপর আসে ডাচ, তারপর ফরাসি, এবং সবশেষে ব্রিটিশ। ১৭ শতকের শেষে কলকাতায় যখন কায়েম হয়ে বসছে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, তখন থেকেই শহরে ক্রমশ সংখ্যায় বাড়তে থাকেন সেই আদি পর্তুগিজ বণিকদের বংশধররা। যাঁদের অধিকাংশকেই বলা হত ‘ইউরেশিয়ান’, অর্থাৎ ইউরোপীয় এবং এশিয়ান-এর মিশ্রণ। ক্রমে যত বাড়তে লাগল কলকাতায় বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সংখ্যা, ততই প্রয়োজন হয়ে পড়ল আলাদা আলাদা নির্দিষ্ট পাড়ার। বলা হয়, পর্তুগিজদের মধ্যে যেহেতু হাঁস-মুরগি পালনের চল ছিল বেশি, তাই তাঁদের এলাকার নাম হয়ে যায়, 'মুর্গিহাটা'। আর, গির্জার নাম হয় ‘মুর্গিহাটা চার্চ’!

Old Mission Church, Kolkata
Old Mission Church-Kolkata: এই গির্জার প্রতিষ্ঠাতা আদতে সুইডেনের নাগরিক এবং লুথেরান মতাবলম্বী ধর্মপ্রচারক জোহান জ্যাকারায়া কিয়েরনান্ডার। (ছবি: কলকাতা পুলিশ)

ওল্ড মিশন গির্জা

এই গির্জার প্রতিষ্ঠাতা আদতে সুইডেনের নাগরিক এবং লুথেরান মতাবলম্বী ধর্মপ্রচারক জোহান জ্যাকারায়া কিয়েরনান্ডার। কলকাতার দ্বিতীয় প্রাচীনতম গির্জার পত্তন হয় ১৭৭০ সালে। যার জন্য নিজের খরচে ১৭৬৭ সালে জমি কেনেন কিয়েরনান্ডার। নির্মাণ শেষ হলে তিনি গির্জার নাম দেন ‘বেথ টেফিলা’ (হিব্রু ভাষায় উপাসনা গৃহ)। তবে গির্জার নির্মাণে ব্যবহৃত লাল পাথরের দৌলতে স্থানীয়দের মুখে মুখে এর নাম হয় যায় ‘লাল গির্জা’। আজ যদিও লাল রঙের কোনও চিহ্নই নেই। পুরোনো কলকাতা নিয়ে কিছু লেখায় এমনও বলা হয়েছে যে এই গির্জা থেকেই আজকের বিবাদি বাগের জলাশয়ের নাম হয় লালদিঘি। সমসাময়িক শিল্পীদের আঁকা কিছু ছবি দেখলে বোঝা যায়, এই ধারণার উৎস। সেকালের লালদিঘির আয়তন ছিল আরও বড়। সুতরাং আজকের আর এন মুখার্জি রোডে অবস্থিত লাল গির্জা অনায়াসেই ছায়া ফেলতে পারত দিঘির জলে।

St James’ Church, Kolkata
St James’ Church-Kolkata: স্থানীয়রা নাম দেন ‘জোড়া গির্জা’। (ছবি: কলকাতা পুলিশ)

সেন্ট জেমস গির্জা

স্থাপত্যের নিরিখে সম্ভবত কলকাতার সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন গির্জাগুলোর অন্যতম সেন্ট জেমস-কে স্থানীয়রা নাম দেন ‘জোড়া গির্জা’। আজও যার যমজ শিখর দেখা যায় বেশ খানিকটা দূর থেকে। ১৮৬২ সালে নির্মিত এই গির্জা ছিল আমহার্স্ট স্ট্রিটের কাছে নেবুতলা লেনে অবস্থিত আদি সেন্ট জেমস গির্জার উত্তরসূরি। নির্মাণের আগেই বলা হয়েছিল, গির্জার পাশাপাশি তৈরি হবে স্থানীয় শিশুদের জন্য একটি স্কুলও, যা পরবর্তীতে হয়ে ওঠে সেন্ট জেমস স্কুল। নতুন গির্জা এবং স্কুল পূর্ণ সমর্থন লাভ করে আর্চডিকন প্র্যাট-এর। শুধু তাই নয়, নিজের প্রভাব খাটিয়ে গির্জা এবং স্কুলের জন্য জায়গাও তিনিই জোগাড় করে দেন। সেই জায়গা হল জনৈক মিস্টার কোটস-এর বাগানবাড়ি এবং তার সংলগ্ন বিস্তৃত জমি। (তথ্যসূত্র: কলকাতা পুলিশের ফেসবুক পেজ)

আরও পড়ুন- সাহেব চোররা নাজেহাল করে তুলেছিল কলকাতা পুলিশকে, সাহসিকতার সঙ্গে কাজে করেছেন বাঙালি পুলিশকর্মীরা

kolkata police kolkata news kolkata
Advertisment