কলকাতার প্রাচীনতম দুর্গা মন্দিরের দিকে যাওয়ার পথে একটি বিভ্রান্তি আছে। এখানে রয়েছে সর্বমঙ্গলা মন্দির। যেখানকার বিগ্রহ দেবী দুর্গারই ভিন্ন রূপ। এই মন্দির আবার চিত্তেশ্বরী দুর্গা মন্দির থেকে মাত্র কয়েক পা দূরে। অনেকে এই মন্দিরকেই চিত্তেশ্বরী দুর্গা মন্দির ভেবে ভুল করেন। কারণ, এর গম্বুজটি দূর থেকে স্পষ্টভাবে দেখা যায়। কিন্তু, আসল চিত্তেশ্বরী দুর্গা মন্দির এর কয়েক হাত দূরে। ১৬১০ সালে নির্মিত এই মন্দির। একে দেখে অনেকে ভাবেন বোধহয় কোনও বসতবাড়ি।
এই আসল চিত্তেশ্বরী মন্দির ভারতের অন্যতম প্রাচীন অস্ত্র কারখানা— কাশীপুর গান অ্যান্ড শেল কারখানার পাশে। মন্দিরের বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক কাশীশ্বর রায়চৌধুরী বললেন, 'দেবীর নামের সঙ্গে মিল রেখে এই এলাকার নাম হয়েছে চিৎপুর। দীর্ঘ সময় এই বিগ্রহ জঙ্গলে পড়ে ছিল। এই দেবীর মাহাত্ম্য এতটাই যে তিনি না-ডাকলে আপনি এখানে আসতেও পারবেন না।'
আরও পড়ুন- নবরাত্রির ষষ্ঠ দিনে আজ আরাধনা হচ্ছে দেবী কাত্যায়নীর, কী মিলবে দেবীর উপাসনায়?
কলকাতার প্রাচীনতম দুর্গা মন্দিরের গল্প শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, সত্যিই যেন রোমাঞ্চকর। এই শহর কলকাতা প্রতি দুর্গাপুজোয় চলন্ত জনপদে পরিণত হয়। সেই শহরেই একাধিক বিখ্যাত স্থায়ী দুর্গা মন্দির রয়েছে। যেমন- চিৎপুরের চিত্তেশ্বরী মন্দির, কুমোরটুলির ঢাকেশ্বরী মন্দির, দক্ষিণ কলকাতায় হরিশ মুখার্জি রোডের ২৩, পল্লি দুর্গা মন্দির। এর মধ্যে ২৩ পল্লি দুর্গা মন্দিরের সম্পাদক সুব্রত সাহা বললেন, '১৯৭০-এর দশকে, এলাকার একজন ব্যক্তি স্বপ্ন দেখেছিলেন। স্বপ্নে দেবী তাঁকে বলেছিলেন যে তিনি একটি স্থায়ী মন্দির চান। অবশেষে, একটি মন্দির তৈরি করে দুর্গার একটি ধাতব মূর্তি স্থাপন করা হয়।'
চিত্তেশ্বরী দুর্গা মন্দিরের দুর্গা অবশ্য ধাতব নয়, কাঠের। দুর্গাপুজোর সময় শহর কলকাতার বেশিরভাগ প্যান্ডেলে মূর্তি বা ফাইবারের দুর্গার পূজা হয়। চিত্তেশ্বরী দুর্গা তার থেকে আলাদা। কাঠ দিয়ে এই মূর্তি তৈরির পরিকল্পনা করেছিলন চিতে ডাকাত। এখানকার দুর্গা দেবীর মূর্তি মন্দিরের ঐতিহ্যের সঙ্গে মানানসই। কাশীশ্বর রায়চৌধুরী বলেন, 'প্রায় ৬০০ বছর আগে এখানে বসবাসকারী চিটে ডাকাত একজন রবিন হুডের মতো ব্যক্তিত্ব ছিলেন। চিতে ভয়ংকর ডাকাত ছিলেন। তিনি ধনীদের থেকে লুট করে গরিবদের মধ্যে সম্পদ বিতরণ করে দিতেন। সুধীরকুমার মিত্র তাঁর ঐতিহাসিক বই 'দেব-দেবীর কথা ও কাহিনী'তে জানিয়েছেন যে কীভাবে চিতে ডাকাত ধনী জমিদার ও ব্যবসায়ীদের ডাকাতির আগে চিঠি পাঠাতেন। শোনা যায়, একদিন দেবী এসে তাঁকে স্বপ্নে বলেন যে পরের দিন সকালে পাশের নদীতে একটি কাঠের তক্তা ভেসে আসবে। তা থেকে তাঁকে মূর্তি খোদাই করতে হবে। পরের দিন সকালে, একটি কাঠের তক্তা পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া গঙ্গায় ভেসে যাচ্ছিল। চিতে ডাকাত তা থেকে একটি মূর্তি খোদাই করেন। আপনি এখানে যা দেখতে পাচ্ছেন, এটাই সেই মূর্তি।' এখানে দেবীর বাহন বাঘ। দেবীর সঙ্গে লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ নেই। এই মূর্তিটি এখানে ৬০০ বছর ধরে রয়েছে। আমরা বছরে একবার শুধু রক্ষণাবেক্ষণের জন্য এঁকে নিই।'
কিংবদন্তি অনুসারে, চিতে ডাকাত দেবীর কাছে নরবলি দিতেন। কিন্তু, চিতের মৃত্যুর পর পরিস্থিতি বদলে যায়। তাঁর কুখ্যাতির জন্য কেউ এই মন্দিরে আসত না। দীর্ঘদিন দেবী প্রায় পরিত্যক্ত হয়ে পড়েছিলেন। অবশেষে ১৫৮৬ সালে নরসিংহ ব্রহ্মচারী নামে এক সাধক এই মূর্তি জঙ্গল থেকে উদ্ধার করে তা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন। স্থানীয় জমিদার গোবিন্দরাম মিত্র এই কথা জানতে পেরে নরসিংহ ব্রহ্মচারীর কাছে আসেন। দেবীর মন্দির নির্মাণের প্রস্তাব দেন। অবশেষে, ১৬১০ সালে এই মন্দির তৈরি হয়। ব্রহ্মচারী ও তাঁর শিষ্যরা মন্দিরের সেবায়েতের দায়িত্বে ছিলেন। নরসিংহ ব্রহ্মচারী তাঁর শিষ্যদের অবিবাহিত থাকার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু, অষ্টম প্রজন্মের শিষ্য বিয়ে করেন। তাঁর দুটি কন্যাসন্তান হয়। তার মধ্যে একটি কন্যাসন্তানের বিয়ে হয় রায়চৌধুরী পরিবারে। সেই থেকে এই মন্দিরের সেবায়েত রায়চৌধুরীরা।
কাশীশ্বর সেই পরিবারেরই উত্তরসূরি। কাশীশ্বর তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে ভারতীয় বিমানবন্দরের কর্মী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তবে, সবসময় তিনি মাথায় রাখতেন, এই মন্দিরের দায়িত্ব রয়েছে তাঁর কাঁধে। তাঁর কথায়, 'এই মন্দিরই আমার কাছে মহাবিশ্ব।' কিন্তু, তাঁর পর কী হবে এই মন্দিরের? তাঁর মেয়ে ঋতুপর্ণা ও ছেলে চন্দ্ররূপ বহুজাতিক সংস্থার কর্মচারী। চন্দ্ররূপ বললেন, 'যদি আমাকে কয়েক বছরের জন্য শহর ছেড়ে যেতেও হয়। আমি এই মন্দির দেখভাল করার জন্যই ফিরে আসব। কারণ, এই মন্দির আমার কেরিয়ারের চেয়েও অনেক বড়।'
Read full story in English