জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিতে হাঁসফাঁস অবস্থা মধ্যবিত্তের হেঁশেলে। বিগত একপক্ষ কাল ধরে লাগাতার বেড়েই চলেছে পেট্রোল ডিজেলের দাম। ফল এবং আনাজ বাজার আগুন! ছুঁলেই ছ্যাঁকা খাওয়ার জো! দম ছুটেছে সাধারণের। সংসার চালানোই এখন দায় হয়ে পড়েছে খেটে খাওয়া আম আদমির। কলকাতায় ডিজেল সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছে। রোজই বাড়ছে পেট্রল- ডিজেল দাম। সেই সঙ্গে ক্যারিং কস্ট এই দুই বিষয়কেই মূল্যবৃদ্ধির জন্য দুষেছেন বাজার কমিটি গুলি।
চাষির ঘর থেকে বাজারে আনাজ-সবজি পৌঁছাতে ভরসা ‘ছোট হাতি’। এদিকে ডিজেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে পরিবহন খরচা বেড়েছে অনেকটাই। এই নিয়ে ইতিমধ্যেই সুর চড়িয়েছেন একাধিক সংগঠন। পাহাড় থেকে সমতল অগ্নিমূল্য বাজার। ত্রাহি ত্রাহি রব উঠেছে মধ্যবিত্ত বাঙালির। একে করোনার কারণে বিশ্ব অর্থনীতির নাজেহাল অবস্থা। তার মধ্যেই জ্বলছে বঙ্গের আনাজ-বাজার।
এক ধাক্কায় আনাজের দাম বেড়েছে অনেকটাই। প্রতি কেজি ১০ থেকে ২০ টাকা দাম বৃদ্ধির ছ্যাঁকায় হাঁসফাঁস অবস্থা সকলের। সেই সঙ্গে চলছে রমজান মাস। যদিও এই মূল্যবৃদ্ধির কারণ হিসেবে জ্বালানিকেই দুষছেন আনাজ ব্যবসায়ীরা।
তাঁদের কথায়, পরিবহন খরচ বেড়েছে অনেকটাই, সেই সঙ্গে চাহিদার বৃদ্ধি মূল্যবৃদ্ধির অন্যতম কারণ বলেই মত তাঁদের। তাই ‘আগুন’ লেগেছে বাজারে। মানিক তলা বাজারে আজ সকালে বাজার করতে এসেছিলেন বৈদ্যনাথ মণ্ডল। তাঁর কথায়, “চাল ডাল আনাজের দাম চড়া। সেই সঙ্গে পাতিলেবুর দাম রেকর্ড ছুঁয়েছে। নিস্তার নেই ফল বাজারে গিয়েও। রোজের আনাজ কিনতেই পকেটে টান পড়েছে। আগে সপ্তাহে তিন দিন আসতেই এখন তা কমিয়ে দু’দিনেই যতটুকু প্রয়োজন সবজি কিনে রাখেন”। যদিও এক ক্রেতার কথায়, “আনাজ সহ পাতিলেবুর দাম বৃদ্ধি অনেকটাই কৃত্রিম”।
এক আনাজ ব্যবসায়ী সুশান্ত দেবনাথের কথায়, “চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফলন সেভাবে হয়নি অনেক সবজির সেই সঙ্গে ডিজেলের দাম বৃদ্ধির কারণেই বাজারের এমন আগুন হাল।” ভোজন রসিক বাঙালির পাতে কমেছে হরেক রান্নার পদ। কেউ কেউ আবার অন্য খাতের খরচ কমাতে বাধ্য হয়েছেন। লেক টাউনের বাসিন্দা পদ্মা দত্ত জানিয়েছেন, “করোনা পরবর্তীতে এমনিতেই মানুষের রোজকার তলানিতে ঠেকেছে, তার উপর ‘আগুন আনাজে’ সংসার চালানোই দায়। আগের থেকে বাজার খরচ বেড়েছে অনেকাংশেই”। কোলে মার্কেটের এক ব্যবসায়ী সাগর দাস বলেন, “এখান থেকে কলকাতার বিভিন্ন বাজারে আনাজ পরিবহন খরচ প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে, যার মাশুল গুনতে হচ্ছে বাজার করতে আসা মধ্যবিত্তকে।”
শিয়ালদহ পাইকারি বাজারের এক ব্যবসায়ী মহাদেব দাস জানান, “গতবছরের তুলনায় এই বছর পরিবহন ব্যয় বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ, একথা যেমন ঠিক তেমন এটাও ঠিক চাষিরা সেইভাবে ফসলের দাম পাচ্ছেন না”। তাঁর কথায় অবিলম্বে পেট্রল ডিজেলের হাল ধরতে সরকারকে ব্যবস্থা নিতে হবে, নাহলে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাবে’। যেভাবে রোজ পাল্লা দিয়ে বাড়ছে পেট্রোপণ্যের দাম তাতে এই দাম আরও বাড়বে বলেই মনে করছেন ভেন্ডার সমিতিগুলি।
কিন্তু কী কারণে এই দাম বৃদ্ধি। জানা যাচ্ছে, এই দাম বৃদ্ধির পিছনে লুকিয়ে রয়েছে জ্বালানির দাম বৃদ্ধি। এক ফল ব্যবসায়ীর কথায়, “তেলের দাম লাগাতার বাড়ার জন্য ফলের দাম বেড়েছে। ট্রাক লোড, আনলোডের সঙ্গে যুক্ত এক ব্যক্তির কথায়, ‘আগে নাসিক থেকে কলকাতায় আঙুর নিয়ে আসতে যে লরি ভাড়া নিত ৯০ থেকে ৯৫ হাজার টাকা, সেই এখন ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা চাইছে।’”
কলকাতার একাধিক বাজার ঘুরে দেখা গিয়েছে বাজার করতে কার্যত হিমসিম খেতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। গতকালই মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশের পর মানিকতলা বাজারে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরের আধিকারিকরা ঘুরে দেখেন বাজারের সামগ্রিক অবস্থা। এদিকে আজ কলকাতার একাধিক বাজারের ছবিটা একবার দেখে নেওয়া যাক, কোন জিনিসে বাজার দর ঠিক কত ছিল!
সরষের তেল ২০০ থেকে ২২০ টাকা, সাদা তেল ১৭৫ টাকা প্রতি কেজি। রুই মাছ ২০০ থেকে ২২০ টাকা। কাতলা মাছ ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা, চারা মাছ ২০০ টাকা, বাটা মাছ ২৫০ টাকা, কাঁঠালি কলা ৭০ থেকে ৭৫ টাকা ডজন। আপেল ভাল ১৫০ টাকা প্রতি কিলো, আঙ্গুর ১২০ টাকা প্রতি কিলো, শসা ৫০ থেকে ৬০ টাকা প্রতি কিলো, পেয়ারা ১১০ টাকা প্রতি কিলো। পাকা বেল, আনারস সহ হরেক রকমের ফলের দাম যথেষ্টই বেশি। বেদনা ১৬০ টাকা প্রতি কিলো, তরমুজ ২৫ থেকে ৪০ টাকা কিলো। কাঁঠালি কলা ৬৫ থেকে ৭৫ টাকা প্রতি ডজন। খেজুর ১০০ টাকা থেকে ৬০০ টাকা প্রতি কিলো।
এদিকে একাধিক বাজার কমিটির সূত্রের খবর গতবারের তুলনায় এবার আনাজের দাম বেড়েছে ৩০ থেকে ৩০ শতাংশ। এদিন বাজারে বেগুন ৭০ টাকা প্রতি কিলো পাতিলেবু ১০ থেকে ১২ টাকা টাকা পিস। পটল বিক্রি হয়েছে ৫০ থেকে ৬০ টাকা প্রতি কেজি। বেগুন বিক্রি হয়েছে ৭০ টাকা কিলো, ঝিঙে ৬০ টাকা কিলো, ক্যাপসিকাম ৫০ টাকা কিলো, গাজর ৩০ থেকে ৪০ টাকা কিলো। ৩০ টাকা কিলো টমেটো, লঙ্কা ১০০ টাকা কিলো, লাউ ২৫ থেকে ৩০ টাকা পিস। আলুর দাম ফের কিছুটা বেড়েছে জ্যোতি আলু ২২ টাকা প্রতি কিলো। চন্দ্রমুখী ২৮ থেকে ৩০ টাকা প্রতি কিলো। । পেঁয়াজ ২৫ থেকে ৩০ টাকা, আদা ৮০ টাকা, রসুন ১০০ টাকা থেকে ১৫০ টাকা প্রতি কিলো। লাউ ৩০ টাকা। ভেন্ডি ৫০ থেকে ৬০ টাকা। মুসুরির ডাল ১২০ টাকা প্রতি কিলো, মুগডাল ১৬০ টাকা প্রতি কিলো।
প্রায় ২০ বছর ধরে চালের ব্যবসা করেন হরেন দেবনাথ। তাঁর কথায়, ‘মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে চালের দাম যেভাবে বেড়েছে সেটা রেকর্ড’। ফাইন বাসমতি চালের দাম এক সপ্তাহ আগে ছিল ৯৬ টাকা, এদিন ছিল ১০০ টাকা। সিদ্ধ বাসমতি চালের দাম এক সপ্তাহ আগে ছিল ৬২ টাকা এখন ৬৬ থেকে ৬৮ টাকা। মিনিকেট চালের দাম এক সপ্তাহ আগে ৪৪ টাকা ছিল এখন ৪৬ টাকা। বাঁশকাটি চালের দাম এক সপ্তাহ আগেই ছিল ৫২ টাকা থেকে ৫৫ টাকা এখন ৫৮ টাকা থেকে ৬০ টাকা। রত্না চালের দাম এক সপ্তাহ আগে ছিল ৩৫ টাকা এবং ৩৮ টাকা। দাম বেড়ে এদিন বাজার দর ছিল ৩৬ টাকা থেকে ৪০ টাকা।
এদিকে মধ্যবিত্তকে সুরাহা দিতে মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে বৃহস্পতিবার নবান্নে মিটিং করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়। সেই সঙ্গে সরকারি আধিকারিকদের বাজার দর ঘুরে দেখার পরামর্শও দেন তিনি। পাশাপাশি সুফল বাংলা স্টলের সংখ্যা বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি। ৩৩২ থেকে বাড়িয়ে ৫০০টি সুফল বাংলা স্টল তৈরির নির্দেশ মুখ্যমন্ত্রীর। তিনি বলেন, 'রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় সরকারের সুফল বাংলা স্টল চালু আছে। বাজার দরের থেকে কম দামে বিক্রি হচ্ছে সুফল বাংলায়'। ৩৩২টি থেকে বাড়িয়ে ৫০০ সুফল বাংলার স্টল তৈরির প্রস্তাব দেন তিনি। তাঁর কথায়, 'প্রয়োজনে সুফল বাংলা স্টলের সংখ্যা বাড়াতে হবে।' পাশাপাশি রমজান মাসের দিকে তাকিয়ে সুফল বাংলার স্টলে তরমুজ, পেপে, খেজুরের দাম কমানোর প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি।