ঢাকে পড়ল কাঠি, বাজল কাঁসর ঘণ্টাও। কিন্তু সেই উল্লাস ধরা পড়ল না। আলোর তেজেও অনেকটা কম। নম নম করে কোনো রকমে জোগার হয়েছে পুজোর। যার সঙ্গে আগের বছর ক্যাপ ফাটিয়েছিল রাহুল, তার ঠিকানা এবার ও জানে না। তাই একা একা পুরোনো পোশাকে বসে আসে মন্ডপের এক কোনে। সোনালি অনেকটা দুরে চলে গেছে তাই আর বের হবো না। ওদিকে রোজগারের জন্য হন্নে হয়ে ঘুরছেন কার্তিক দাস। পাড়ার পুজোর জন্য ইনি সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব নিতেন ঘাড়ে। এরকম ভাবেই কাটছে ৫৭ বছর ধরে ধুমধাম করে পালন করা পাঁচ নম্বর স্যাঁকরা পাড়া লেনের দুর্গাপুজো।
গত বছরও দুর্গা পিতুরি লেন স্যাঁকরা পাড়ায় পুজোর আলোর রোশনায় ছিল ভরপুর। এবছর একটু দূরে পুজো হলেও তা যেন প্রাণহীন। কলকাতা শহরে মেট্রোর সুড়ঙ্গ খুঁড়তে গিয়ে ঘরছাড়া হতে হয়েছে কয়েকশো মানুষকে। সেইসব বাড়ি ও গলি-তস্যগলি এখন জনমানবশূন্য। মানুষের যাতায়াতেও নিষেধ রয়েছে। জল নেই, মানুষের অস্তিত্বহীন হয়ে উঠেছে এই সব এলাকা। কয়েকটা পরিবার যারা ফিরে এসেছেন তাঁদের চোখে মুখে এখনও আতঙ্কের ছাপ।
পুজোর আনন্দে মেতে উঠেছে সবাই। তবে দুর্গা পিতুরি লেন স্যাঁকরা পাড়ার বাসিন্দারা খুঁজছে মাথা গোজার নতুন ঠিকানা। ৩১শে অগাস্ট রাত থেকেই বদলে যায় মধ্যে কলকাতার কিছু মানুষের জীবন। বউবাজারের দুর্গা পিতুরি লেন ও স্যাঁকরা পাড়া লেনের কয়েকটি বাড়িতে ফাটল দেখা যায়।
রাত থেকেই সেই বাড়িগুলির বিভিন্ন অংশ ভেঙে পড়তে শুরু করে। ধসে পড়ে কয়েকটি বাড়ি। তিনটি পাড়া মিলে এই পাড়ায় একটায় পুজো হয়। অনেকে ভেবেছিলেন এবছর পুজো করা সম্ভব হবে না। তবে পাড়ার বাসিন্দাদের বিশেষ অনুরোধে ছোট করে পুজো হচ্ছে। স্যাঁকরা পাড়ায় পুজো হলেও তা যেন জৌলুসহীন।
যারা ফিরে এসেছেন তাঁদের প্রত্যেকের গলাতেই দুঃখের সুর। জয় ভট্টাচার্য স্যাঁকরা পাড়ায় গত চারবছর ধরে পুজো করতে আসেন। তার কথায়, এই পাড়াতে পুজোর সময় একটা সাজো সাজো রব থাকে সবার বাড়িতে। এ বছর বেশিরভাগ বাড়ি ভেঙ্গে পড়েছে। বাড়ির লোকজন নেই। যেন ভূতুরে পাড়া হয়ে গেছে।
রাধারানী সাউ এই পাড়ার ৭০ বছরের বাসিন্দা। এবছর পুজোর কয়েকদিন পরেই তাঁর মেয়ের বিয়ে। ভাঙ্গা বাড়িতে দাঁড়িয়ে এখন ঈশ্বরের উপর ভরসা রাখা ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারছেন না। দুর্গা পিতুরি লেনে কয়েক কদম দূরে বেলু-বাড়ি নামে পরিচিত বাড়ির পুজোও কেমন ফিকে। এই বাড়ির বাসিন্দারা বলছেন, গত বছরও পাড়ার বন্ধুবান্ধব সবাই মিলে বাড়িটা জমজমাট ছিল। কিন্তু এবছর অনেকেই বাড়িছাড়া।
দুর্গা পিতুরি লেনের মুখেই দুর্গাপুজোটার বয়স দুই শতক বা তার কাছাকাছি। বৌবাজারের অভিশপ্ত গলির এই বাড়িতে এবারও পুজো হচ্ছে জৌলুসহীন।এ বছর পুজোয় ঢাক বাজবে না। তার বদলে কাঁসর চলবে কিংবা ঢাকের সিডি বাজবে। মতিলালেদের মধ্যে প্রবীণতম দ্বারিকবাবুর আবছা শৈশব-স্মৃতি বলছে, একদা সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী মিলিয়ে ন’টি পাঁঠা বলি হত দুর্গাদালানে।
সপ্তমীতে চিংড়ি, বিজয়া দশমীর মেনুতে ইলিশ ভাজা ছিল বাঁধা। এ বার সেই মেনুতেও কাটছাঁট হতে পারে! এই বাড়ির সামান্য দূর পর্যন্ত সব বাড়ি ভেঙ্গে গিয়েছে। এই বাড়িটা কিভাবে যে বেঁচে গেল তা ভেবে উঠতে পারছেনা বাড়ির বাসিন্দারা। এই বাড়ির পুজোটাকেই দুর্গা পিতুরির পুজো নামেই চেনেন সকলে। সকলে মনে করছেন মা দুর্গা আসবেন বলেই হয়তো এই বাড়িটাকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন। তা না হলে এই বাড়ির তলা থেকেও মাটি সরে যেত। দুর্গাপুজোকেই সম্বল করেই সকলেই আশার আলো খুঁজছেন বাসিন্দারা।