Kolkata Police: বাঙালির সাদা চামড়ার প্রতি বিশেষ প্রীতি থাকতেই পারে। কিন্তু, আঠারো এবং উনিশ শতকে কলকাতায় সাদা চামড়ার ‘সাহেব চোর’-দের কীর্তিকলাপ কলকাতা পুলিশকে কিন্তু রীতিমতো নাজেহাল করে ছেড়েছিল। এই ‘white collar criminal’-রা মোটেই কপর্দকশূন্য ছিল না। শুধু তাই নয়, এদের মধ্যে কয়েকজন তৎকালীন ইউরোপীয় সমাজের উচ্চমহলে অবাধে বিচরণ করতেন। তার মধ্যে আবার কয়েকজনের ধূর্ততা আর দুর্দান্ত শারীরিক ক্ষমতা ছিল উল্লেখ করার মত।
- সাহেব চোররা রীতিমতো নাজেহাল করে ছেড়েছিল কলকাতা পুলিশকে।
- বিদেশি চোরদের অনেকেরই ওপরমহলে অবাধ যাতায়াত ছিল।
- সাহসিকতা ও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে কাজ করেছেন বাঙালি পুলিশ আধিকারিকরা।
কলকাতা পুলিশের ইতিহাসে এইসব অপরাধীদের কথা আছে। তাদের মধ্যে দু’জনের কথা, একনিঃশ্বাসে উচ্চারিত হয়েছে ১৮৮৮-৮৯- এর ‘ক্যালকাটা পুলিস ক্রিমিনাল রেকর্ডস’-এ। ওই দুই অপরাধী হল- ওয়ার্নার এবং হিলি। যাদের প্রথম পরস্পরের সাক্ষাৎ হয়েছিল জেলে। এর মধ্যে ওয়ার্নার ছিলেন ডালহৌসির কাছে সিঙ্গার সেলাই মেশিন কোম্পানির ম্যানেজার। সিঙ্গার ইউরোপের নামকরা ব্র্যান্ড হওয়ার সুবাদে শহরের উচ্চকোটির ইউরোপীয় মহলে বা কলকাতার বিখ্যাত ক্লাবগুলোতে ওয়ার্নার ছিল যথেষ্ট পরিচিত মুখ। এহেন ওয়ার্নার যখন ১৮৮৬ সালের ১৮ অক্টোবর সকালে ওয়াটারলু স্ট্রিটে এসে হাজির হল দোকানে চুরির অভিযোগ নিয়ে, পুলিশ যথোচিত গুরুত্বও দিয়েছিল ওয়ার্নারের বক্তব্যকে। সেই বক্তব্যের নির্যাস ছিল, সোমবার সকালে দোকানে যাওয়ার পর ওয়ার্নার দেখেন যে মূল দরজার বিশেষ তালাটা খোলা। ভিতরে অফিসের ড্রয়ার লন্ডভন্ড। সোনারুপোর গয়না ছাড়াও ড্রয়ারে থাকা টাকাও খোওয়া গিয়েছে। টাকা-গয়না মিলিয়ে যা চুরি গিয়েছে, তার অর্থমূল্য ৬ হাজার টাকার কাছাকাছি। ওয়ার্নারের আরও অভিযোগ ছিল, কোম্পানিরই তিনজন জুনিয়র কর্মচারী এই চুরির সঙ্গে যুক্ত। তদন্তে নেমে পুলিশ দ্রুত সিদ্ধান্তে আসে, কোম্পানিরই কেউ এ কাজের সঙ্গে যুক্ত। কারণ, বিশেষ তালাটি খোলা হয়েছে চাবি দিয়েই স্বাভাবিক পদ্ধতিতে। কোনও বিকৃতির চিহ্ন তালায় ছিল না। আর, বিস্তারিত তদন্তে পুলিশ নিশ্চিত হয়, ওই বিশেষ তালাটির চাবি একমাত্র ওয়ার্নারের কাছেই থাকত। চুরিটা ওয়ার্নারই করেছেন। অন্য কারও পক্ষে সম্ভবই নয়।
এই তদন্তের প্রেক্ষিতে ওয়ার্নারের বিরুদ্ধে অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গের মামলা দায়ের করে কোম্পানি। জানা যায়, ৪৮,৮৯৪ টাকা (সে যুগে যা কয়েক কোটির সমান) অর্থমূল্যের টাকা ও গয়না খোওয়া গিয়েছে। মামলা দায়ের হওয়ার আগের রাত্রেই কলকাতা থেকে উধাও হয়ে যায় ওয়ার্নার। তদন্তে নেমে পুলিশ জানতে পারে, চোরাই গয়নার মধ্যে একটি, নিউ মার্কেটের কাছে কলিঙ্গ বাজারে এক ইউরোপীয় যৌনকর্মীকে উপহার দিয়েছিল ওয়ার্নার। ওই যৌনকর্মীই পুলিশকে জানান, একটি প্যাকেটে আরও কিছু গয়নাগাটি ওয়ার্নার পাঠিয়েছে তাঁর বোম্বেনিবাসী মা-কে। প্রায় বছরখানেক পরে ওয়ার্নারের হদিশ শেষমেশ পাওয়া যায় রেঙ্গুনে (বর্তমানে ইয়াঙ্গন)। গ্রেফতারির পর কলকাতায় বিচারপর্বের শেষে চার বছরের সশ্রম কারাবাসে দণ্ডিত হয় ওয়ার্নার। ঠাঁই হয় প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেটস জেলে। এই জেলেই ওয়ার্নারের সঙ্গে আলাপ হয় তারই মতো আরেক ‘কীর্তিমান’-এর।
সেই ‘কীর্তিমান’-এর নাম হিলি। যার ইংল্যান্ড থেকে ভারতে আগমন হয়েছিল সৈন্য হিসাবে। উনিশ শতকের শেষার্ধে হিলি অংশ নিয়েছিল একাধিক যুদ্ধে। মিরাটে ‘Her Majesty’s own Scottish Regiment’-এর সদস্য ছিল হিলি। কিছুদিন পর হঠাৎই সেনার চাকরি ছেড়ে দিয়ে ফিরে যান ইংল্যান্ডে। দ্রুতই জড়িয়ে পড়ে অপরাধের দুনিয়ায়। ডাকাতদের একটি কুখ্যাত গ্যাং-এর সঙ্গে যুক্ত হিলি বেশিদিন থাকতে পারেনি ব্রিটেনে। গ্রেফতারি এড়াতে ফের ফিরে আসেন কলকাতায়। ঠাঁই নেয় মধ্য কলকাতার ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান স্ট্রিটের এক হোটেলে।
আরও পড়ুন- মঙ্গলবার নেতাজির জন্মদিনে মেট্রোয় বিরাট বদল, বাড়ি থেকে বেরনোর আগে সাবধান!
হিলির কলকাতায় আসার অল্পদিনের মধ্যেই হঠাৎ করে একের পর এক রহস্যজনক চুরির ঘটনা ঘটতে শুরু করে মধ্য কলকাতায়। প্রায় সব ক্ষেত্রেই চোরের টাগের্ট এলাকার সম্পন্ন ইউরোপীয় পরিবারগুলো। নজরদারি বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েও কোনওভাবেই চোরের নাগাল পাচ্ছিল না পুলিশ। সম্ভাব্য চোরকে কোনও বাড়িতে ঢুকতে বা বেরোতে দেখেছে ঘটনাচক্রে, এমন কিছু প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গে কথা বলে বিভ্রান্তি আরও বাড়ে পুলিশের। কেউ দাবি করেন, চোর একজন মুসলিম এবং অত্যন্ত সন্দেহজনক তার ঘোরাফেরা। কেউ আবার বলেন, চোর ইহুদি সম্প্রদায়ভুক্ত। আবার কারও মতে, চোর আসলে একজন ইউরেসিয়ান। হাজার চেষ্টা করেও যখন কোনও কূলকিনারা পাচ্ছেন না কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দারা, হঠাৎই একদিন রাত্রে নজরদারির সময় একটি বাড়ির মধ্যে চোরকে নাগালের মধ্যে পেয়ে যায় পুলিশ!
আরও পড়ুন- সাহেবরাও কম চোর নন! গ্রেফতার করেছেন বাঙালি গোয়েন্দা, শুনলে অবাক হবেন
কিন্ত নাগালের মধ্যে পাওয়া এক, আর নাগাল পাওয়া আরেক। পুলিশ দেখামাত্রই ‘সাহেব চোর’ হিলি অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতায় বাড়ির পাঁচিল টপকে পরের বাড়ির উঠোনে ঝাঁপ মারে। এর পর শুরু হয় রুদ্ধশ্বাস চোর-পুলিশ খেলা, যা সিনেমাকেও হার মানায়। একের পর এক বাড়ির পাঁচিল টপকে পালাচ্ছে চোর, পিছনে একইভাবে ধাওয়া করার আপ্রাণ চেষ্টা করছে পুলিশ। সে সময়ের এক আধিকারিকের বয়ানে, 'পাঁচিল টপকানোর ওই স্টিপলচেজের খেলায় চোর অনেক বেশি দক্ষ ছিল পুলিশের তুলনায়।' আরেক অফিসারের স্বীকারোক্তি, 'যথেষ্ট উচ্চতার পাঁচিল একের পর এক দ্রুত টপকে যাওয়া এবং ছোটখাটো ফাঁক-ফোকরের মধ্যে দিয়ে একই গতিতে চোরকে ধাওয়া করার মতো দক্ষতা পুলিশের ছিল না।' আর, ছিল না বলেই পুলিশের সামনেই অন্ধকারে মিলিয়ে গিয়েছিল ‘সাহেব চোর’। পরে অবশ্য ধরা পড়ে। ১৮৮৮ সালের শেষাশেষি প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেটস জেলে ঠাঁই হয়েছিল হিলির।