Advertisment

অচ্ছ্যুত! পথকুকুরদের আশ্রয় হয়ে আক্রান্ত সহ-নাগরিকরা, কেমন অভিজ্ঞতা তাঁদের?

Kolkata Street Dog: এমন অনেক সহ-নাগরিক আছে, তাঁরাও সারমেয়-মার্জার নিয়ে দিব্য বেড়ে উঠেছেন। প্রতিদিনের রুটিনের অংশ করেছেন পোষ্যদের। তাঁদের কথা শুনল দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা।

author-image
Joy Deep Sen
New Update
Street Dog, Stray Dog, Pet Care

একটু ভালোবাসার জন্য। ছবি শশী ঘোষের ক্যামেরায়।

Kolkata Street Dog: আবাসনে পশু নির্যাতনের প্রতিবাদ করে পাল্টা হেনস্তার শিকার হয়েছেন অভিনেত্রী শ্রীলেখা মিত্র। অভিনেত্রীর সারমেয় প্রেম ইতিমধ্যে পরিচিত। তাঁর দেওয়া  ‘সারমেয় দত্তক’ নেওয়ার পোস্ট ঘিরে বেশ শোরগোল পড়েছিল। তবে শুধু শ্রীলেখা মিত্র নয়, টলিউডের বড় এবং ছোট পর্দা মিলিয়ে এমন অনেক পরিচিত মুখ আছে, যাদের সারমেয় প্রেম সন্তানসম।  যেহেতু এঁরা প্রত্যেকেই পরিচিত মুখ, এঁদের পশুপ্রেম নিয়ে চর্চা বিস্তর। কিন্তু এমন অনেক সহ-নাগরিক আছে, তাঁরাও সারমেয়-মার্জার নিয়ে দিব্য বেড়ে উঠেছেন। প্রতিদিনের রুটিনের অংশ করেছেন পোষ্যদের। তেমনই কয়েকজন সহ-নাগরিকের সঙ্গে কথা বলেছে দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা। যাঁদের অনেকে নানাভাবে পোষ্যপ্রেমের জন্য পড়শিদের কু-কথার শিকার। অনেকে আবার বিষয়টা সয়ে নিয়েই নিজের সন্তানের মতো বড় করে চলেছেন পোষ্যদের।

Advertisment

বেলুড়ের তরুণী ইন্দ্রাণী তপাদার। একটা সময় ছিল তিন সারমেয় নিয়ে তাঁর সংসার। সম্প্রতি বিঙ্গো নামে একটি সারমেয় মারা গিয়েছে। তাই সেভাবে আর সারমেয়র প্রতি আন্তরিক নয় ইন্দ্রাণী। পথ কুকুরদের দেখলেও এড়িয়ে চলে সে। তবে তাঁর এই সারমেয় প্রেম ছোটবেলা থেকে বাড়ি লোক প্রশয় দিয়েছে। সেই ইন্দ্রাণী বলেছেন, ‘আমরা বাড়িতে মাংস না খেলেও, তিন পোষ্যের জন্য নিয়ম করে বাড়িতে মাংস ঢুকত। পৃথক ভাবে সেই মাংস রান্না করে তাদের খাওয়ানো হতো।‘ বাড়ির পোষ্যর চিৎকারের জন্য মাঝে মধ্যেই পড়শিদের বক্রোক্তি শুনতে হয়েছে আমাদের।

publive-image
এই পথ কুকুরদের পক্ষ নেওয়ায় হেনস্তা হতে হয় অনেক সহ-নাগরিককে। ছবি: শশী ঘোষ

তবে, একবার রাস্তার এক সারমেয়র জন্য তাঁকে অনেক কথা শুনতে হয়েছিল। দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলাকে এমনটাই জানান তিনি। ইন্দ্রাণী বলেন, ‘একটা সময় নিয়ম করে সেই সারমেয়র জন্য খাবার দিয়ে আসতেন বাড়ি থেকে একটু দূরে গিয়ে। প্রথম কয়েকদিন সবকিছু ঠিকঠাক ছিল। কিন্তু একদিন খাবার দিয়ে বাড়ি ফিরে এসে শুনি ব্যাপক হইচই, চিৎকার চেঁচামেচি। কী হয়েছে বেরিয়ে গিয়ে দেখি, সেই কুকুরকে খাবার দেওয়া নিয়ে সমস্যা। সে নাকি সেই খাবার মুখে করে এর, তাঁর বাড়িতে গিয়ে ফেলে আসছে। এমনকি, অনেক বাড়ির সামনে সে মলত্যাগ করে এসেছে। এই অভিযোগ ওকে ঘিরে ওঠে। আমি-ই নাকি ভিন পাড়ার সেই কুকুরকে খাওয়ারের লোভ দেখিয়ে এই পাড়ায় নিয়ে এসেছি। তারপর থেকেই নাকি এই উৎপাত শুরু।‘

তিনি আরও বলেন, ‘আমি কিছুতেই বুঝিয়ে পারলাম না ও এই পাড়ার। এবং ওদের শান্ত করতে এটাও বললাম এরপর থেকে আমার বাড়িতে ঢুকিয়েই ওকে খাওয়াবো। আপনাদের বাড়ির সামনে খাওয়ারের টুকরো থাকবে না এই গ্যারান্টি দিতে পারি। কিন্তু ওরা যেন সেই সারমেয়কে ক্ষুধার্ত মারবে, এমন একটা পণ করে ছিল। আমার কোনও আকুতিতেই কান দেয়নি। কিছুতেই ওকে পাড়ায় খাওয়ার দেওয়া যাবে না, এভাবেই আমাকে শাসিয়ে গিয়েছে। অগত্যা জলে থেকে যেহেতু কুমিরের সঙ্গে লড়াই করা যাবে না। তাই পাড়ার বাইরে বের করে ওকে খাওয়ার দিয়ে আসতাম। একটা সময় সে, আমার অবস্থা বুঝতে পেরে নিজেই পাড়ার বাইরে চলে যেত। এখন ওকে এই পাড়ায় আর দেখাও যায় না।‘

publive-image
পথ কুকুরদের খাওয়াচ্ছেন পশুপ্রেমী ইন্দ্রাণী রায় চৌধুরী। তাঁকেও নানাভাবে হেনস্তা হতে হয়েছে। ছবি: শশী ঘোষ

একই সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন পেশায় নৃত্যের শিক্ষিকা মৌ সাহা। বেলঘরিয়ার এই তরুণীর সঙ্গেই তাঁর পরিবারে বেড়ে উঠেছিল এক পথ কুকুর। তার মৃত্যুর পর আরও একটা পথ কুকুরকে দত্তক নিয়েছেন মৌ। বয়স বাড়ার সঙ্গে সে-ও বেড়েছে তাঁদের বাড়িতেই। সেই শিক্ষিকার বক্তব্য, ‘আমার পোষ্য বেশ শান্ত। খুব একটা সমস্যা তৈরি করে না। শুধু বাইরের কোনও লোক দেখলে একটু চেঁচায়, আমার ধমক শুনে আবার শান্ত হয়ে যায়। তাই ওকে নিয়ে পাড়ায় কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু সারমেয়দের একটা অদ্ভুত প্রবৃত্তি আছে, ওরা যদি বুঝে যায় এই ব্যক্তি পশু-প্রেমী বা সারমেয়প্রেমী। তাহলে ঘুরেফিরে সেই ব্যক্তির বাড়ির সামনে বা পিছনে আসে।‘

তিনি বলেন, ‘বেশ কয়েকবছর আগে এরকম একদল সারমেয় আমার পিছু নেয়। আমার বাড়ি পর্যন্ত এসে আবার নিজেদের ঘাঁটিতে ফিরে যায়। তো ওদের পিছু নেওয়া দেখে একদিন আমি বিস্কুট দেওয়া শুরু করি। এবার ওদের একবার বিস্কুট দেওয়া মানে, সেটা নিত্যকর্মের সঙ্গে জুড়ে নেওয়া। এভাবেই চলতে থাকে।‘

তিনি জুড়েছেন, ‘এভাবে একদিন খাওয়ার দিয়ে বাড়ি ফিরতেই কানে আসে কতগুলো কুকুরের চিল-চিৎকার। আমি আর মা বেরিয়ে দেখি, পাড়ারই একজন ওদের লক্ষ্য করে ইট ছুঁড়ছে। প্রথমে মা তাঁকে উদ্দেশ্য করে প্রতিবাদ করে। তিনিও পাল্টা মা-কে দু-চার কথা শুনিয়ে দেয়। তাঁর বক্তব্য, এদের চিৎকারে রাতের দিকে ওর বাচ্চা জেগে যায়। যার জন্য সারা রাত ওদেরও জেগে থাকতে হয়। তাই আপদ বিদায় করতে এই ব্যবস্থা। তখন আমি গর্জে উঠি, প্রশ্ন করি এরাই তারা? তুমি নিশ্চিত? আমার প্রশ্নে সে হতচকিত হলেও, পাল্টা আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। ওরা কারা আমার জানার দরকার নেই। অসুবিধা হলে প্রয়োজনে বিষ দিয়ে মারব। এই কথা শুনে পাড়ার অন্যরা প্রতিবাদ করলে সে একটু কুঁকড়ে যায়। কিন্তু তারপর থেকে আমি আর ঝুঁকি নিই না। যে দোকান থেকে বিস্কুট কিনি সেখানেই ওদের খাইয়ে, বুঝিয়ে বাড়ি ফিরি। আমার বাড়ির সামনে ওরা আর জটলা করে না। তাই সেই পড়শির বাচ্চাও আর জেগে যায় না।‘

পথ কুকুর না হলেও, বাড়ির পোষ্যর জন্য আত্মীয়রা আসা বন্ধ করে দিয়েছিল শুভ্রা চক্রবর্তীর বাড়িতে। পেশায় এলআইসি এজেন্ট এই তরুণীর অভিযোগের সুরে মন্তব্য, ‘মিকু খুব একটা সমস্যা তৈরি করে না। শুধু বাড়িতে নতুন কেউ এলে তাঁকে শুঁকে বোঝার চেষ্টা করে, সেই ব্যক্তি বিপজ্জনক নাকি। যদি বুঝে যায় সে আমাদের পরিবারের পরিচিত, তাহলে তাঁর পায়ের তলায় গিয়ে আশ্রয় নেয়। এরম আচরণ করায় অনেক আত্মীয় বাড়ি আসা বন্ধ করে দেয়। তাঁদের বক্তব্য, কুকুরে খানিকটা এলার্জি, খানিকটা ভীতি, যদি কামড়ে দেয়। তাই তোদের বাড়ি যাই না রে।‘

তবে উপরের তিনটি অসংবেদনশীল উদাহারণের বিপরীত চিত্র আছে। বিরাটি ঘুরে সেই চিত্র পাওয়া গিয়েছে। এক দম্পতি প্রতিদিন টোটোয় চেপে নিমতা থেকে বিরাটি বিগ বাজারের সামনে এসে ৮-১০টি সারমেয়কে খাইয়ে, তারপর সেই টোটোয় চেপে বাড়ি ফেরেন। কেন এই আচরণ? প্রশ্ন করায় তাঁরা জবাব দেন, ‘এর আগে দুটো ব্রিড পুষে কাউকে ৭ বছরের বেশি বাঁচাতে পারিনি। তাই দু’জনেই ঠিক করেছি আর বাড়িতে কোনও পোষ্য ঢোকাব না। বরং পথ কুকুরদের খাইয়ে যাব। আমারই এক বন্ধু খবর দেয় বিগ বাজারের সামনে একসঙ্গে ৮-১০টা ঘুরে বেড়ায়। নিমতা থেকে তাই টোটো চেপে আসি। আমাদের রান্না, আশপাশের দুই-তিন বাড়ির রান্না জুড়ে ওদের খাওয়াই। এখনও কোনও সমস্যা হয়নি। বরং অনেকে এগিয়ে এসেছেন।‘

publive-image
এই অবলা চতুষ্পদদের জন্য কী ভাবনা প্রশাসনের? ছবি: শশী ঘোষ

সেই দম্পতি বলেন, ‘বিগ বাজারের আশপাশের অনেক দোকানি, তাঁদের দিনের শেষে পড়ে থাকা খাওয়ারও স্বেচ্ছায় আমাদের দিয়ে যায়। সেই সব দিয়ে হয়ে যায়।‘ এদিকে, বিরাটি স্টেশন রোড এলাকায় থাকেন সুধীর বাগচি। অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী। তাঁর রাতে ঘুমনোর আগে একটাই কাজ, ‘এলাকার ৫-৬টি পোষ্যকে ডেকে এনে খাওয়ানো। একটা বড় বালতি করে তিনি খাবার আনেন। ৪-৫টি পৃথক জায়গায় সেই খাবার ঢেলে কখনও ধমকে, কখনও বাবা-বাছা করে পথ কুকুরদের খাওয়ান। খাওয়া শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করেন। সবকটি খাওয়ার পাত্র তোলেন, জায়গা জল দিয়ে ধুয়ে বাড়ি ঢোকেন।

সেই সুধীর বাবু জানান, ‘করোনার সময় একটা দীর্ঘদিন বাইরে বেরোয়নি। পুজোর আগে একটা সময় কলকাতার বাইরে ছিলাম। প্রতি অনুপস্থিতিতেই ওদের জন্য মন খারাপ হত। কিন্তু ফিরে শুনতাম কেউ অভুক্ত থাকেনি। বাজার-ব্যবসায়ী সমিতির কেউ না কেউ, ঠিক ওদের খাইয়ে দিত।‘ একটু অভিমানের সুরেই তিনি বলেন, ‘এখন ওদের খাওয়ানোর লোক অনেক, তাই আমার ডাল-ভাত মুখে তোলে না।‘

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন

Dog Lovers
Advertisment