/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2021/08/Untitled-design-2021-08-26T163514.065.jpg)
শিক্ষক তমাল ভট্টাচার্য। ছবি সৌজন্য: হোয়াটসঅ্যাপ
Afghanisthan Update: দিন কয়েক আগে কাবুল থেকে দেশে ফিরেছেন নিমতার শিক্ষক তমাল ভট্টাচার্য। তালিবানি ‘আতিথেয়তায়’ থাকা এই শিক্ষক মায়ের কোলে ফিরলেও, এখনও চোখেমুখে উদ্বেগের ছাপ স্পষ্ট। নিমতার ওলাইচণ্ডীতলায় তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখা গিয়েছে সেই ছবি। বাবা-মা থেকে আত্মীয়-স্বজন ঘরের ছেলেকে কেউই আপাতত চোখের বাইরে যেতে দিতে নারাজ। সংবাদমাধ্যমের ভিড় তমালের বাড়ির বাইরে জমলে পড়শিদের উৎসুক ভিড়ও চোখে পড়ছে। যুদ্ধদীর্ণ একটা দেশ, বিশেষ করে তালিবানের খপ্পর থেকে কেন্দ্র-রাজ্যের উদ্যোগে দেশে ফিরে এখন খানিকটা সময় নিজের মতো করে কাটাতে চান এই শিক্ষক। এই পরিবেশে আসরফ ঘানি যুগ থেকে সশস্ত্র তালিবানি বাহিনীর দাপট প্রত্যক্ষ করা নিমতার শিক্ষক তমাল ভট্টাচার্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলার সঙ্গে একান্ত আড্ডায় ঠিক কী কী বললেন!
আফগান মুলুককে আসরাফ ঘানির সরকার থেকে তালিবানি কব্জায় চলে যাওয়ার রূপান্তর একেবারে চাক্ষুস করেছেন তমাল। কেমন ছিল আসরাফ ঘানির আমলে আফগানিস্তান? আফগানদের জীবন যাত্রা এবং সংস্কৃতি? সেই বিষয়ে তমাল বলেন, ‘যুগ যুগ ধরে চলতে থাকা গৃহযুদ্ধে জর্জরিত আফগানিস্তানকে শূন্য থেকে শুরু করতে হয়েছিল তালিবান যুগের প্রথম পর্বের অবসানের পর। কুড়ি বছরে আফগানিস্তান অনেকটাই ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছিল। সে শিক্ষা হোক বা স্বাস্থ্য-পরিকাঠামোর উন্নয়ন। আমি যখন কাবুলে পৌঁছলাম প্রায় বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম কাবুলকে দেখে। চারদিকে আধুনিকতার ছোঁয়া। একটা শহর বলতে আমরা যা বুঝি, সেটাই এখন কাবুল নামে আমার সামনে দাঁড়িয়ে। এতটাও রূপান্তর আমি আশা করিনি। সত্যি বলতে, আর পাঁচজন গড়পড়তা মানুষের মতোই ভেবেছিলাম, কাবুলের প্রতিটি কোণে জীর্ণতার ছোঁয়া থাকবে। যা আফগানিস্তানের শতাব্দীর করুণ ইতিহাসের প্রমাণ কিংবা যুদ্ধদীর্ণতার ইতিহাস বয়ে বেড়াবে। অনুন্নত পরিকাঠামো, সঙ্কীর্ণ মানসিকতায় ধুঁকতে থাকা নগর সমাজ এই আর কী!'
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2021/08/kabul-1-1.jpg)
তিনি বলেন, ‘কাবুলে পৌঁছে দেখলাম বিশ্বের অন্য সভ্য, উন্নত দেশের মতো আফগানিস্তানেও কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের যোগদান। ব্যাঙ্ক থেকে শিক্ষাক্ষেত্র সবেতেই মহিলারা স্বত:স্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করছেন। কাবুলের এই বদলে যাওয়া ছবি আমার মনে আশা জাগালো। আফগানিস্তান অবশেষে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তবে এটাও বলতে হবে যে সব আফগান মহিলারা আধুনিক সভ্যতার মিছিলে সামিল হয়েছিলেন। কারণ, তখনও কিছু কিছু জায়গায় মহিলাদের পুরুষ ঘেরাটোপের মধ্যেই জীবন অতিবাহিত করতে হচ্ছিল। এই যেমন বাড়ির বাইরে পা রাখার সময় পরিবারের কোনও পুরুষ সদস্যের সঙ্গে থাকা আবশ্যক ছিল। তবু তুল্যমূল্য বিচারে ১৯৯৬-২০০১-এর তালিবান শাসনের প্রথম পর্বের অবসানের পর এই পরিমিত স্বাধীনতা যথেষ্ট উপভোগ করছিলেন আফগান মহিলারা।‘
সে দেশের অতিথি দেব ভব প্রসঙ্গে এই শিক্ষক জানান, আফগানিস্তান অতিথি আপ্যায়নের জন্য পরিচিত। তাই আফগানিস্তানে পা রাখার পর থেকে আমার এক মূহূর্তের জন্যও নিজেকে বহিরাগত মনে হয়নি। আমার প্রতি তাদের শ্রদ্ধা, ভালবাসা কোনও কিছুতেই খামতি ছিল না। বরং আমাকে তাদের একজন হয়ে উঠতে সাহায্য করেছিল আফগানি আতিথেয়তা। এই জন্য খুব তাড়াতাড়ি আমি ওদের সঙ্গে মিশে যেতে পেরেছিলাম। আমার উপস্থিতি সেখানে এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছেছিল, স্থানীয় দোকানীরা আমার থেকে জিনিসের দাম নিতেন না। এছাড়াও, যে সমস্ত স্থানীয়দের সাথে আমার সখ্যতা গড়ে উঠেছিল, ব্যাঙ্ক হোক বা স্থানীয় বাজার, তারা আমার সর্বক্ষণের সঙ্গী ছিল। কারণ বহিরাগতদের জন্য এই বিশেষ জায়গাগুলি খুব একটা নিরাপদ ছিল না।
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2021/08/kabul-2-1.jpg)
এই পরিবেশে কাবুল-সহ দেশের অন্য প্রদশে ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলা শুরু করল তালিবানরা। একে একে দখলে চলে গেলো দেশের একাধিক প্রাদেশিক রাজধানী। আফগানিস্তান যখন পুনরায় তালিবান কব্জায় যাওয়া শুরু করল তখন কেমন ছিল সেইসব দিন? আশা-আশঙ্কার দোলাচলে কীভাবে কাটছিল সাধারণ মানুষের দিন? এই প্রসঙ্গে তমাল বলেছেন, 'যেভাবে তালিবানরা একের পর এক প্রাদেশিক রাজধানী দখল করা শুরু করেছিল, কাবুল পতন শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা ছিল। এটাই আমরা ধরে নিয়েছিলাম এবং হয়েছেও তাই। তাবড় দেশের রাষ্ট্র প্রধানদের ভবিষ্যদ্বাণী উপেক্ষা করে সময়ের আগেই তালিবান কাবুলকে কব্জায় নিল। রাজধানী দখলের পরে গোটা আফগানিস্তান পথে এসে দাঁড়ায়। যেন তাঁদের মাথার উপর আকাশ ভেঙে পড়ল। যেদিকেই তাকাও এক ভীষন নৈরাজ্য, হুলুস্থুলু। প্রাণভয়ে সবাই দেশ ছাড়তে বিমানবন্দরে জমায়েত বাড়াল। রাস্তায় লোকজন কার্যত জ্ঞানশূন্য হয়ে ছোটাছুটি শুরু করল। তাঁদের মনে তখন কুড়ি বছর আগের তালিবান রাজের স্মৃতি। তাই যেভাবেই হোক ভিটেমাটি, পূর্বপুরুষের স্মৃতি ছেড়ে আফগানরা দলে দলে জড়ো হওয়া শুরু করে হামিদ কারজাই এয়ারপোর্টের উত্তর দিকের গেটে। এই দৌড়াদৌড়ির মধ্যেও চলেছে গুলি। কত মানুষ যে সেই গুলির আঘাতে কিংবা পদপৃষ্ট হয়ে মারা গিয়েছে! তার কোনও হিসেব নেই। কেউ কেউ এতটাই মরিয়া ছিলেন যে দেশ ছাড়তে প্লেনের চাকার ওপর উঠে বসে পড়েছিলেন। তার পরিণতি কী হয়েছে, আমরা বিভিন্ন গণমাধ্যমে দেখেছি। এর আগে এভাবে আমি আমার চোখের সামনে মানব জগতের অস্তিত্বকে সঙ্কটের মুখে পড়তে দেখিনি।'
এদিকে একে একে যখন সে দেশ থেকে নাগরিকদের উদ্ধার করা শুরু করল একাধিক দেশ, সেই সময় স্বল্প দিনের জন্য হলেও শিক্ষক তমাল ভট্টাচার্য কিছুদিন তালিবানী নিরাপত্তায় ছিলেন। তাদের আতিথেয়তা পেয়েছেন। সেই স্বল্পদিনের আতিথেয়তা এবং তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে তালিবান রাজ কিংবা তালিবানদের সঙ্গে থাকার অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে তমাল বলেন, ‘আমি এবং সঙ্গী অন্যরা প্রায় ছয়দিন তালিবানদের রাজত্বে কাটিয়েছি। আমি বলতে চাই সেই ছয় দিন মিশ্র অভিজ্ঞতা হয়েছে। কখনও মনে হয়েছিল, বাইরে কোনও গণ্ডগোল হলে ওরাই আমাদের রক্ষা করবে। আবার কখনও ভয়ও লেগেছিল। আসলে আমরা তালিবানকে পুরোপুরি বিশ্বাস করে উঠতে পারছিলাম না। তাই দুশ্চিন্তাও পিছু ছাড়ছিল না। আর শুধু তালিবানের ভয় না, আফগানিস্তানে আরও অনেক সন্ত্রাসবাদী সংস্থা আছে, যারা সেই সময়ে সুযোগের সদ্ব্যবহার করে আমাদের অপহরণ করে মেরেও ফেলতে পারত। সারাক্ষণই এক চাপা উদ্বেগে দিন কাটাচ্ছিলাম। কিন্তু কিছু করার ছিল না, কারণ যা তোমার হাতে নেই, তাকে মেনে নেওয়া ছাড়া আর কী-ই বা করার থাকে একটা মানুষের।‘
তিনি এই প্রসঙ্গে আরও বলেছেন, ‘এই অনিশ্চয়তার আবহ চলে গিয়েছিল, যখন আমরা তালিবানের কাবুল জয়ের ১৫ ঘন্টা পর তাদের কিছু নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। প্রথমে তো মনে হয়েছিল যে এই শেষ। কিন্তু না, ওদের সঙ্গে সময় কাটিয়ে মনে হল আমরা এখনও আশরাফ ঘানির রাজত্বেই আছি। সেভাবে কিছুই বদলায়নি। ওরা আমাদের সঙ্গে খেয়েছে, ক্রিকেট খেলেছে, আমাদের কী পেশা, জানতে চেয়েছে। স্কুল-কলেজ আবার কবে থেকে শুরু করা যায় সেই নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কীভাবে আমরা আফগান ছাত্র-ছাত্রীদের সাহায্য করতে পারি, সেটাও আলোচনা হয়েছে। কারণ ওদের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, এই ডামাডোলের মধ্যে পড়ে আফগান ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশোনার যাতে কোনও ক্ষতি না হয়। এমনকি তারা, আমাদের ‘উস্তাদ’ (আফগানরা শিক্ষকদের এই ভাষায় সম্বোধন করে) বলেও সম্বোধন করেছিল। এবং বলেছিল যেন আমরা আফগানিস্তান না ছাড়ি। আফগানিস্তানে থাকলে ওরা আমাদের শ্রদ্ধা, আতিথেয়তা, সুরক্ষা কোনওকিছুর খামতি রাখবে না। এমন প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিল। কিন্তু এভাবে জোরাজুরির পরেও সত্যি বলতে ভরসা পাইনি। ওদের ইতিহাস এবং সাম্প্রতিক ইতিহাস যার সাক্ষী আমি নিজে ছিলাম। সেই ইতিহাস ঘাঁটলে ওদের মুখের কথার ওপর ভরসা করে বিশ্বাস করা বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়। তাই কোনও পরিস্থিতেই আমরা রাজি হইনি আফগানিস্তান থাকতে।‘
তিনি জানান, যে দুটি জিনিস তাঁকে বারবার আফগানিস্তানে ফিরে যেতে তাগাদা দেবে, সেটা আফগান নারী এবং সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা ভাবনা। এই দুটি জিনিস সে দেশে একেবারেই নেই বললেই চলে। একটি গণতান্ত্রিক-ধর্মনিরপেক্ষ দেশের নাগরিক এবং একজন শিক্ষক হয়ে তাঁর, ওদের এই পরিণতি মেনে নিতে কষ্ট হয়। তিনি কোনওভাবেই কোনও উগ্রপন্থার পক্ষপাতী নয়।
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2021/08/Untitled-design-2021-08-24T151509.298-1.jpg)
তমাল বলেছেন, ‘যদিও তালিবান, তাদের ২.০ আমলে উন্নয়ন নিয়ে অনেক লম্বা-চওড়া প্রতিশ্রুতিই দিয়েছে। যেখানে তারা আধুনিকতার ছাপ রাখতে চেয়েছে। যেমন মহিলাদের পড়াশোনা, কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণ, সংখ্যালঘুদের সমান অধিকার ইত্যাদি, ইত্যাদি। তবে এত তাড়াতাড়ি এগুলোকে বিশ্বাস করা বোধহয় ঠিক হবে না। সময়ই বলবে তালিবানের কথার সঙ্গে কাজের কতটা মিল।‘
যদি ভবিষ্যতে ফের সুযোগ আসে, ফিরবেন তিনি আফগানিস্তানে? এই প্রশ্নের জবাবে এই শিক্ষক বলেন, ‘ওরা যেভাবে পেশি-শক্তি ও হিংসায় ভর করে একটা দেশ জবরদখল করল, আমি এটাকে একেবারেই সমর্থন করি না। তাই তালিবানের ২.০ শাসনব্যবস্থাকে বৈধতা দিতে আমার যথেষ্ট অসুবিধা আছে। সেই জন্যই আমার আফগানিস্তান ফিরে যাওয়া অনেক কিছুর উপর নির্ভর করবে। আমি আগে দেখতে চাই ওরা নারী এবং সংখ্যালঘু সুরক্ষা ও সমানাধিকার নিয়ে কতটা কাজ করছে। তারপর আমার ফিরে যাওয়া নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু করব। একমাত্র একটি স্থিতিশীল আফগানিস্তান, যেখান জাতি-ধর্ম-লিঙ্গ ভেদে সবাই সুরক্ষিত এবং স্বাধীন। সে রকম আফগানিস্তানই আমার মতো মানুষদের ওখানে যেতে এবং ওদের একজন হয়ে সেই দেশের উন্নয়নের হাল ধরতে উদ্বুদ্ধ করবে।‘
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন