বায়ু দূষণ কিংবা পরিবেশ দূষণ দুটোই ক্রমশ দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ভারতে বায়ু দূষণ সব থেকে বেশি দিল্লিতে। কিছুদিন আগে কলকাতার এই বায়ু দূষণ দিল্লীকেও টেক্কা দিয়েছে। আমরা মুখে পরিবেশ সচেতনতার কথা বললেও, কিন্তু তার কতটুকু মেনে চলি? আমাদের রোজনামচা আমাদের নিজেদের অজান্তেই হয়ে উঠছে ক্ষতিকর। উত্তরাধিকার সূত্রে সে ক্ষতি ভবিষ্যৎ প্রজন্মেরও।
বাতাসে প্রতিনিয়ত মিশছে বিষ, খাবারে ভেজাল। আমরা গাছ লাগান পরিবেশ বাঁচানোর কথা বলি আর আমরাই গাছ কেটে ফেলি নির্দ্বিধায়। দোষারোপ করি একে অন্যকে। ২০১৫ সাল থেকে এই পরিবেশ বাঁচানোর লড়াই করে যাচ্ছেন দমদমের পার্থসারথি গঙ্গোপাধ্যায়। দমদম স্টেশন থেকে দশ মিনিটের হাঁটা পথ সেভেন ট্যাঙ্কস লেন। পার্থসারথি বাবু নিজের পাড়াটাকেই সাজিয়ে তুলেছে নানান রঙ বাহারি গাছে।
পরিবেশের সব থেকে বড় শত্রু প্ল্যাস্টিক। আর এই প্ল্যাস্টিক দিয়েই সাজিয়ে তোলা হয়েছে বাগান। কলকাতার ইট কাঠ পাথরের কংক্রিটের জঙ্গলেও যেন চারপাশে সবুজের সমরহ। পার্থ বাবুর বাড়ির এলাকায় ঢুকতেই চোখে পরবে গাছেদের বাগান। ছোট বড় সব মিলিয়ে দশ হাজারেরও বেশী গাছ রয়েছ। সব গাছের ঠিকানা কোন মাটির টবে নয়, রয়েছে প্ল্যাস্টিকের বোতল, টিনের ক্যান, টায়ার, টিনের জারে। শুধু তাই নয় তাতে আবার রং বেরঙের ছবিও আঁকা। পরিত্যক্ত জিনিস দিয়েও এমন সুন্দর জিনিস তৈরি করা যায়, তা ভাবা যায় না! অসম্ভবকে সম্ভব করে দিয়েছেন এই পরিবেশ প্রেমী।
এই মুহূর্তে গোটা দেশে বায়ু দূষণ নিয়ে বিস্তর চর্চা চলছে। ক্লাইমেট চেঞ্জ, বিশ্ব উষ্ণায়ন নিয়ে চারদিকে হইচই। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন পরিবেশের ভারসম্য বজায় রাখতে পারে একমাত্র গাছই। প্ল্যাস্টিককে যেখানে পরিবেশের শত্রু মনে করা হচ্ছে। পার্থসারথি গঙ্গোপাধ্যায় ফেলে দেওয়া পরিত্যক্ত প্ল্যাস্টিক বর্জ্য দিয়েই তৈরি করেছেন বাগান। যদিও প্রথমে পরিবেশ বাঁচানোর উদ্দেশ্যে নিয়ে এই কাজ তিনি শুরু করেননি।
২০১৫ সালে অবসর নেওয়ার পর থেকেই তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়েন তাঁর সাধের বাগান তৈরিতে। দিনের বেশিরভাগ সময়টাই দেন গাছ পরিচর্যায়। তখন থেকে গাছ লাগানোর এই নেশা তাঁকে পেয়ে বসে। 'অনেকে বলেন গাছ লাগানোর জায়গায় নেই, সবই অজুহাত আমার বাড়ির সামনে কতটুকুই বা জায়গা আছে! যতটুকু জায়গা আছে সবটায় ব্যবহার করেছি। লাইটপোস্ট, গাছের ডাল, ঘরের বারান্দা সব জায়গাতেই গাছ রয়েছে। আমার ইচ্ছে ছিল আমি করতে পেরেছি। এখন বাড়ি নোংরা হয় বলে অনেকে গাছ কেটে ফেলে। এমন হলে সবুজ হারিয়ে যাবে' বলেন পার্থ বাবু।
ইচ্ছের জোরে কেমন বাগান তৈরি হয় তা ছবি দেখে হয়তো আন্দাজ করা যায়। বাতিল প্লাস্টিকের বোতল ও অন্যান্য সামগ্রী দিয়ে দুর্গা, স্বরস্বতী, গণেশ-সহ নানান দেব দেবীর মূর্তি। ছোট ছোট বোতল দিয়ে তৈরি হয়েছে দুর্গার হাত। ঢাকনা দিয়ে বানানো হয়েছে চোখ। ভাঙ্গা সিডি এবং ওষুধের ফয়েল দিয়ে তৈরি করেছে গয়না। এক দিকে ফেলে দেওয়া বর্জ্যকে শিল্পের রূপ দেওয়া, অন্য দিকে সেই শিল্পের গায়েই সবুজ প্রাণের জন্ম দেওয়া। নিজের অজান্তেই তৈরি করে ফেলেছেন এই অভিনব সবুজের বাগান। পার্থ বাবুর এখন বয়স ৬৭ সামনের মাসেই বয়স হবে ৬৮ হাসতে হাসতে নিজের বয়স নিয়ে রসিকতা করে বলছিলেন, 'আমি কিন্তু এখনও মনের দিক দিয়ে এখনও ইয়ং, আমি বুড়ো নই। গাছই আমায় সতেজ বানিয়ে রেখেছে'।
'রাস্তায় বেরোলেই আগে ফেলে দেওয়া প্ল্যাস্টিকের বোতল, টায়ার এসব কুড়িয়ে এনে ধুয়ে মুছে রং করে গাছ লাগাতাম। এখন লোকজন এসেই প্ল্যাস্টিকের পুরনো ভাঙ্গাচোরা জিনিস দিয়ে যায়। আমি নিজের মতন যত্ন করে সাজিয়ে তুলি আমার বাগান।' বলছিলেন পার্থবাবু। ১৯৮৬ তে গলার ভোক্যাল কর্ডে ক্যানসার ধরা পড়ে। অনেক চিকিৎসার পরে সুস্থ হয়ে ওঠেন। এরপর ২০১২ সালে আবার সেই মরনব্যাধি ফিরে আসে। মৃত্যুমুখ থেকে পার্থসারথি গঙ্গোপাধ্যায় আবার ফিরে আসেন। এরপর থেকেই গাছ নিয়ে দিব্যি ভালো আছেন।
গাছই এখন তার একমাত্র পরম বন্ধু। গাছ কাটার কথা বললেই রেগে যান পার্থবাবু, বলেন, 'মানুষই এই পৃথিবীটাকে ধ্বংস করছে, প্ল্যাস্টিক ব্যবহার করতে বারণ করা হলেও কেউ কথা শুনছে না। গাছ লাগানোর কথা বললে সবাই পিছিয়ে আসে। যদি এখন থেকে সচেতন হতে না পারি তবে পরের প্রজন্ম অক্সিজেনটুকুও পাবে না'