ইভানো-ফ্র্যাঙ্কইস্কে বৃহস্পতিবার সকালে যখন বছর ২৩-এর সায়ন চৌধুরীর ঘুম ভাঙে, তখনই তিনি কল্পনাও করতে পারেননি, তাঁর ওই শহর রুশ হামলার শিকার হবে। 'বেলা তিনটেয়, আমরা জানতে পারি বিলি ডিম-এ, অনেকে হোয়াইট হাউসও বলেন, রুশ ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হেনেছে,' ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস ডট কমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এমনটাই জানিয়েছেন সায়ন। ইভানো-ফ্র্যাঙ্কইস্ক এলাকায় ওটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক ভবন। 'কোনও অবস্থাতেই আমাদের বাইরে যেতে নিষেধ করা হল, কারণ (রুশ) সেনা হামলা শুরু করেছে। আমরা ওপরে যুদ্ধবিমানেরও শব্দ পেয়েছি।'
সায়ন চৌধুরী ইউক্রেনের চতুর্ষ বর্ষের ডাক্তারি পড়ুয়া আর ওঁর বাসা ইভানো-ফ্র্যাঙ্কইস্ক আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে চার কিলোমিটার দূরে। যখন বৃহস্পতিবার রাশিয়া প্রথমদিকে বিমানবন্দরে ক্ষেপণাস্ত্র হানা চালাচ্ছিল, সেই সময় সায়ন বাসার ওপরের তলায় গিয়ে আগুন আর ধোঁয়ার ছবি তুলেছে। শহরে হামলার পর, ইউক্রেনের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ফেসবুকে একটা বিবৃতিতে বলেন, 'শত্রুপক্ষ ইউক্রেনের পশ্চিম প্রান্তে হামলা চালিয়েছে। ইভানো-ফ্র্যাঙ্কইস্ক বিমানবন্দর, জ্বালানি এব তেলের ডিপো ক্ষেপণাস্ত্র হানায় ধ্বংস হয়ে গেছে।'
'আমি এই প্রথম ভয় পেলাম। এটিএমেও আর নগদ নেই। ভাগ্যক্রমে, আমি সকালে বেরিয়ে ১০ দিনের মতো খাবার কিনেছি,' ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস ডট কমকে চৌধুরী এমনটাই জানিয়েছেন। ইউক্রেনে এই পরিস্থিতি এবং অনিশ্চয়তার মধ্যে তিনি এখন কী করবেন, বুঝে উঠতে পারছেন উদ্বিগ্ন এই যুবক। বৃহস্পতিবার এয়ার ইন্ডিয়ার যে বিমানটির কিয়েভ থেকে ভারতীয়দের ফিরিয়ে আনার কথা ছিল, তা ইরানের আকাশসীমার ওপর থেকে ফিরে গেছে। কারণ, ইউক্রেন অসামরিক বিমান চলাচল বন্ধ রেখেছে।
পরিস্থিতির অবনতির পর কিয়েভের ভারতীয় দূতাবাসের সামনে আটকে পড়া ভারতীয়রা সাহায্যের জন্য জড় হন। তার মধ্যে বেশিরভাগই পড়ুয়া। এরপরই বৃহস্পতিবার দূতাবাস তাদের তৃতীয় বিবৃতিতে জানিয়েছে, 'আমরা জানি যে কিছু এলাকায় সাইরেন শোনা গেছে। যদি আপনারা এমন পরিস্থিতিতে পড়েন, গুগল ম্যাপে কাছের বম্ব-শেল্টারের ঠিকানা দেওয়া আছে। যার অনেকগুলোই ভূগর্ভের মেট্রোয়।' সায়নের কথায়, 'জীবনে প্রথম এমন অবস্থায় পড়লাম। গত রাত পর্যন্ত ইভানো-ফ্রাঙ্কইস্ক এলাকার অনেক ভারতীয়ই ইউক্রেন-রাশিয়ার দ্বন্দ্ব নিয়ে তেমন একটা চিন্তিত ছিলেন না। কারণ, পাঁচ ঘণ্টা দূরেই পোল্যান্ড সীমান্ত। অনেকেই ভেবেছিলেন নিরাপদে সীমান্ত পেরিয়ে যাবেন। কিন্তু, বৃহস্পতিবার সকাল হামলার পরই পরিস্থিতিটা বদলে গেল।'
শহরে হামলার আগে বিশ্ববিদ্যালয় জানিয়েছিল, ১২ মার্চ থেকে অফলাইন লেখাপড়া শুরু হবে। সায়ন বলেন, 'তাতে আমরা চিন্তিত ছিলাম। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়ে একশো শতাংশ হাজিরা দরকার। কামাই করলে প্রতিটা দিনের জন্য জরিমানা নেয়।' অনেক পড়ুয়াই গত সপ্তাহে দেশে ফিরতে চেয়েছিল। শুধু এই কারণেই ফেরেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ও ভাবতে পারেনি আজ সকালেই হামলা হবে।'
আরও পড়ুন সাইরেন শুনলেই আতঙ্কনগরী কিয়েভে পরস্পরকে ‘চল পালাই’ বলছেন ভারতীয় পড়ুয়ারা
এই অবস্থায়, কী করে ক্লাস হবে, সেই ব্যাপারে পড়ুয়ারা কিছুই বুঝতে পারছে না। সায়ন যখন এই কথা বলছেন, তখন তাঁর বাড়ির লোকজন আবার ছেলের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত। কিন্তু, সায়ন নিজে এখন তাঁর লেখাপড়া, বিশ্ববিদ্যালয়ের কঠোর নিয়মবিধি এবং কেরিয়ার নিয়ে ভেবে যাচ্ছে। আর, এই কারণেই রাশিয়ার হামলার আগে সে ইউক্রেন ছাড়তে পারেনি। এই পরিস্থিতিতেও এয়ার ইন্ডিয়া তাদের টিকিটের দাম কমায়নি। তাই নিয়ে অনেক ভারতীয়ই অসন্তুষ্ট।
সায়ন বলেন, 'আমরা ভেবেছিলাম এয়ার ইন্ডিয়া টিকিটের দাম কমাবে। কিন্তু, টিকিটের দাম এক থেকে দেড় লক্ষ টাকার মতো। ইউক্রেনে পড়তে আসা ৯০ শতাংশ ভারতীয় পড়ুয়ার পক্ষেই এত দাম দিয়ে টিকিট কাটা সম্ভব না।' আর, এই কারণেই সায়নের মতো অনেক ভারতীয় পড়ুয়াই ইচ্ছা থাকলেও ইউক্রেন ছাড়তে পারছেন না। এই পরিস্থিতিতে একমাত্র যদি বিদেশ মন্ত্রক কোনও ব্যবস্থা করতে পারে, এখন সেই ভরসাতেই আছেন ইউক্রেনে আটকে থাকা ভারতীয় পড়ুয়ারা।