Advertisment

ট্রিঙ্কাজের ৬০, ঊষা উত্থুপের ৫০

শুরুতে ট্রিঙ্কাজের দরজার উচ্চতা ছিল ১৮ ফিট। সে দরজা পেরোনোর পরেই ছিল একটা স্টিলের দরজা, কনফেকশনারি থেকে মাছিদের দূরে রাখার জন্য।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Trincas

আজ যেমন (ছবি- নেহা বাঁকা)

অর্ধশতাব্দী আগের সেদিনের কথা বলছিলেন ঊষা উত্থুপ। ট্রিঙ্কাজ-এ তাঁর শুরুর দিনটার কথা। "সে সময়ে লাইভ মিউজিকের মঞ্চে শাড়ি পরা কেউ গান গাইছে এমনটা প্রায় দেখাই যেত না।" তখন কলকাতায় ট্রিঙ্কাজ-এর মত জায়গায় অতিরিক্ত জ্যাকেট আর টাই রেখে দেওয়া হত, যাঁরা ড্রেস কোডের ব্যাপারে খেয়াল না রেখে হাজির হয়ে যেতেন, তাঁদের জন্য।

Advertisment

দশক পেরিয়েছে, পার্ক স্ট্রিটও বদলেছে। রাস্তার ফুটপাথ এখন হকার ও পথচারীদের কুরুক্ষেত্রপ্রায়, তেমন সব রেস্তরাঁ আর বারের সংখ্যাও কমে এসেছে অনেকটাই।

কিন্তু এসব সত্ত্বেও পার্ক স্ট্রিট আর কলকাতার লাইভ মিউজিক সমার্থক হয়ে থেকে গেছে। এখন এবশ্য হাতে গোনা কয়েকটা মাত্র বার ও রেস্তোরাঁয় লাইভ মিউজিকের আয়োজন হয়। কিন্তু ইতিহাসের গন্ধ পার্ক স্ট্রিটের গা থেকে মুছে যায়নি আজও।

গত শতকের ৩-এর দশকে টি রুম ও কনফেকশনারি হিসেবে ট্রিঙ্কাজের শুরু হয়েছিল এক সুইস দম্পতির হাত ধরে। তাঁদের নাম রেকর্ডে খুঁজে পাওয়া যায় না।

শুধু এইটুকু জানা যায়, সেই দম্পতির পদবীর সূত্র ধরে নামকরণ হয়েছিল ট্রিঙ্কাজ-এর। ১৯৫৯ সালে এর হাত বদল হয়। ওম প্রকাশ পুরী ও এলিস জোশুয়া নামের দুজন এটি কিনে নেন এবং স্থির করেন একে রেস্তোরাঁ ও লাইভ মিউজিক বারে পরিণত করবেন।

Trincas, Usha Uthup সংগীত জীবনের ৫০ বছরে ট্রিংকাজে ঊষা উত্থুপ (ছবি নেহা বাঁকা)

 কলকাতা, ভারতের বিনোদন রাজধানী

ওম প্রকাশ পুরীর পুত্র দীপক পুরীর বয়স এখন ৬৮। তাঁর কথায়, "৫এর দশকের শেষ থেকে ৭-এর দশকের শুরু পর্যন্ত ভারতের বিনোদন রাজধানী ছিল এই কলকাতাই। শুধু তাই নয়, সে সময়ে ভারতের আর্থিক রাজধানীও ছিল এ শহর, ফলে সমস্ত কর্পোরেটরাও এখানেই থাকতেন।"

বেশ কয়েকটা কারণ একযোগে থাকায় কলকাতার লাইভ মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির উন্নতি ঘটছিল। ভারতে ব্রিটিশ রাজের সুবাদে ওয়েস্টার্ন মিউজিকের প্রতি আগ্রহ তো ছিলই, তার সঙ্গে পার্ক স্ট্রিট অঞ্চল হয়ে উঠছিল দীর্ঘদিনের কলকাতা বাসী তথা কর্পোরেট কর্মীদের বাসস্থান। উচ্চবিত্তদের জন্য বার-রেস্তোরাঁও ফলে বেড়ে উঠছিল পার্ক স্ট্রিটে।

নন্দন বাগচি, ১৯৭০ সালের এক রক ব্যান্ডে ড্রামার ছিলেন। তাঁর কথায় "কলকাতায় লাইভ মিউজিকের বাণিজ্য গড়ে ওঠে মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে কলকাতাবাসী মার্কিন সেনাদের সুবাদে। পার্ক স্ট্রিট ছাড়াও গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল, মিশন রো ও ধর্মতলার বেশ কিছু জায়গায় বিদেশি সেনাদের জন্য প্রচুর বিনোদনের ব্যবস্থা থাকত বলে জানিয়েছেন তিনি। চৌরঙ্গিতেও বেশ কিছু নাইট ক্লাব ও হোটেল ছিল।"

ফিরপো (১৯১৭ সালে স্থাপিত রেস্তোরাঁ যা বন্ধ হয়ে যায় ১৯৭০-এ) ওবং অনান্য জায়গাতেও লাইভ বিনোদনের বন্দোবস্ত থাকত বলে জানিয়েছেন নন্দন বাগচি। পাঁচ দশক আগে প্রবীণ এই মিউজিশিয়ানের প্রথম পারফরম্যানস ছিল ওই ট্রিঙ্কাজেই, ঊষা উত্থুপের মত।

অ্যাংলো ইন্ডিয়ান- কলকাতার হৃদয়

কলকাতার লাইভ মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিকে খাইয়ে পরিয়ে মানুষ করেছে অ্যাংলো ইন্ডিয়ানরাই, মনে করেন নন্দনবাবু। তাছাড়া এর কৃতিত্ব কিছুটা গোয়ানিজদেরও। ৭ এর দশকে ভয়াবহ মন্দার সময়ে লাইভ এন্টারটেনমেন্টের দুনিয়াও মৃতপ্রায় হয়ে পড়ে।

নন্দন বাগচি ট্রিঙ্কাজের অন্যতম কর্ণধার এলিস জোশুয়ার সঙ্গে তাঁর একদা কথোপকথনের কথা মনে করছিলেন। লোকে এধিক ওদিক নানা কথা বলবে, বলবে যে সরকার বিনোদন কর বসিয়েছে। কিন্তু লাইভ এন্টারটেনমেন্টের এ হালের কারণ অ্যাংলো ইন্ডিয়ানরা এ দেশ ছেড়ে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা এবং ব্রিটেনে চলে গিয়েছে।

পার্ক স্ট্রিটের রেস্তোরাঁ এবং বার থেকেই যাত্রা শুরু করেছিলেন লুই ব্যাঙ্কসের মত তারকা কম্পোজার, প্যাম ক্রেইনেক মত গায়ক এবং জ্যাজ মাস্টার কার্লটন কিটো।

দীপক পুরীর কথায়, "অ্যাংলো ইন্ডিয়ানরা কলকাতার হৃদয় ছিল। ওরা বাঁচত তাৎক্ষণিকতায়। সমস্ত মিউজিসিয়ানরা ওই কমুনিটি থেকে এসেছে। সে সময়ে কলকাতার ভদ্রলোকদের কাছে পাশ্চাত্য সংগীত নিষিদ্ধ বিষয় ছিল। বহু বাবা-মা নিজের সন্তানদের ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সংগীত শেখাতেন।"

শুধু সংগীত বিনোদনই নয়, দীপক পুরী বলছিলেন, "বহু রেস্তোরাঁ ও বারে স্টুয়ার্ড ও কর্মচারীরা ছিল অ্যাংলো ইন্ডিয়ান, কারণ তারা ইংরেজিতে কথা বলতে পারত। সে সময়ে খদ্দেররা মূলত ছিলেন পাশ্চাত্য দ্বারা অতি প্রভাবিত এবং ব্রিটিশ রাজের হ্যাং ওভার ছিল সকলের মধ্যেই... যার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারত অ্যাংলো ইন্ডিয়ানরা। অ্যাংলো ইন্ডিয়ান সম্প্রদায়ই তখনকার কলকাতাকে নির্মাণ করছিল এবং সেরা সংগীত প্রতিভাও ছিল তাদের মধ্যেই।"

কলকাতার লাইভ মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির পতন

৬-এর দশকের শেষ ও ৭-এর দশকের গোড়ায় নকশাল আন্দোলনের সময় রাজনৈতিক টানাপোড়েনের জেরে শহরের সমস্ত ব্যবসা বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের বড় অংশ বিজেষে পাড়ি দিতে শুরু করেন। ব্যবসা শ্লথ হতে শুরু করে। ফিরপো সহ বেশ কিছু সংস্থা বন্ধ হয়ে যায়। বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিনোদনের উপর প্রচুর কর বসায়, উদ্দেশ্যই ছিল লাইভ মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি বন্ধ করে দওয়া। খদ্দেরদের যাতায়াত কমতে থাকে।

দীপক পুরী বলছিলেন, "মিউজিক শোনার জন্য ৩০ শতাংশ কর দিতে হবে, এ একেবারে জঘন্য ব্যাপার ছিল। ধরুন কেউ একজন স্কচ খাচ্ছেন, যার দাম ২০ টাকা। কেউ একজন কোক খাচ্ছেন, দাম এক টাকা। যিনি কোক খাচ্ছেন, তাঁকে ৩০ পয়সা বিনোদন কর দিতে হবে, যিনি স্কচ খাচ্ছেন, তাঁকে ৬ টাকা বিনোদন কর দিতে হবে।"

দীপক পুরীরা আন্দোলন করে যখন এই কর বিলোপ করান, তখন অনেকটাই দেরি হয়ে গিয়েছে। পার্ক স্ট্রিট ও চৌরঙ্গি অঞ্চলের বেশ কিছু রেস্তোরাঁ ইতিমধ্যেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

প্রায় একই সময়ে বেশ কিছু বড় কর্পোরেশন নিজেদের ব্যবসা ভারতের অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যেতে থাকে, যার জেরে পার্ক স্ট্রিটের বাসিন্দারাও কলকাতা ছাড়তে শুরু করেন। বড় বড় ঔপনিবেশিক ধাঁচার বাড়ি গুলো অফিস স্পেসে পরিণত হতে শুরু করে। এখন পার্ক স্ট্রিটের অজস্র ইলেক্ট্রনিক সামগ্রীর দোকান, আধুনিক কাফে ও রেস্তোরাঁয় ভরপুর। সে সময়ের ইতিহাস ধারণ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে শুধু ট্রিঙ্কাজ, ফ্লুরিজ, মোকাম্বো এবং মুল্যাঁ রুজ।

সেই পুরনো স্বাদ

ওমপ্রকাশ পুরী ও এলিস জোশুয়া দুজনে কাজ করতেন চৌরঙ্গির বিখ্যাত গ্র্যান্ড হোটেলে। তাঁদের অভিজ্ঞতাই বলে দিয়েছিল ট্রিঙ্কাজের রূপ বদলের কথা।

প্রথম দু বছর ট্রিঙ্কাজ কে কনফেকশনারি ও টি রুম হিসেবেই চালানো হয়। তখন ছিল বিশাল বেকারি, কেক, পেস্ট্রি, ব্রেড, চা কফিস সব মিলত সেখানে, আজকের ফ্লুরিজের মত। টি রুমের চেহারা বদলালেও নামের আমূল বদল ঘটাননি তাঁরা। ১৯৬১ সালে সিকার সাইসেন্স পাবার পর ট্রিঙ্কাজের বদল সম্পন্ন হয়। শহরের বিনোদনের হটস্পট হয়ে ওঠে ট্রিঙ্কাজ। জোশুয়া মারা যাবার পর পুরীরা ট্রিঙ্কাজের পূর্ণ দায়িত্ব নেন।

শুরুতে ট্রিঙ্কাজের দরজার উচ্চতা ছিল ১৮ ফিট। সে দরজা পেরোনোর পরেই ছিল একটা স্টিলের দরজা, কনফেকশনারি থেকে মাছিদের দূরে রাখার জন্য। এখন সে দরজার উচ্চতা কমেছে। ১৫০ জন বসতে পারে এই রেস্তোরাঁয়। লাইভ মিউজিক ব্যান্ডের জন্য একটা ছোট প্ল্যাটফরম রয়েছে। ১৮ ফুট দরজার জায়গায় এখন কাচের জানালা। সে জানালার কাছে যাঁরা বসার সুযোগ পান, তাঁদের চোখের সামনে থাকে পার্ক স্ট্রিট ও রাসেল স্ট্রিটের মোড় এবং কলকাতার এ অঞ্চলের শে, ঔপনিবেশিক কাঠামোর বাড়ি কুইনস্ ম্যানসন।

ট্রিঙ্কাজে এখন আর ড্রেস কোড নেই, জ্যাকেট আর নেকটাই রেখে দেওয়া হয় না এখানে। সে ব্যবস্থা চলেছিল ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত। দীপক পুরী হাসতে হাসতে বলছিলেন, "সব সময়ে সেগুলো হয়ত গায়ে হত না, কিন্তু এই ড্রেস কোড মনে করিয়ে দিত, ঠিকঠাক ব্যবহার করতে হবে এখানে।"

ট্রিঙ্কাজের সুসময়

Trincas, Usha Uthup পুরানো সেই দিনে ঊষা উত্থুপ (ছবি সৌজন্য ট্রিংকাজ)

ট্রিঙ্কাদের ৬০ বছরের সঙ্গে পালিত হল ঊষা উত্থুপের প্রথম স্টেজ পারফরম্যান্সের ৫০ বছর। গত সপ্তাহে ফের একবার ট্রিঙ্কাজের স্টেজে উঠেছিলেন ঊষা উত্থুপ। তাঁর প্রথম পারফরম্যান্সের দিন যাঁরা সেখানে হাডির ছিলেন, তাঁদের অনেকেই উপস্থিত হয়েছিলেন এদিনও।

ঊষা উত্থুপের অ্যানিভার্সারি পারফরম্যান্সের জন্য কলকাতায় এসেছিলেন ভারত মণি প্রধান। তাঁর বয়স ৭১। থাকেন কালিম্পংয়ে। পেশা প্রকাশনা ও ছাপার বাণিজ্য। "সুদিনের কথা মনে হলেই আমার ট্রিঙ্কাজের কথা মনে পড়ে। নাহলে আমি এতদূর নেমে আসতাম নাকি! আপনি জামাইকা ফেয়ারওয়েল জানেন তো! প্রথমবার এ গান আমি শুনেছিলাম ঊষার গলায়। ও ক্যালিপসো গাইত।"

৭৪ বছরের কাবেরী দত্ত ও তাঁর স্বামী অশোক ট্রিঙ্কাজে এসেছিলেন তাঁদের বন্ধুদের সঙ্গে। "আমরা ঊষা ও জানি (ঊষার স্বামী)-কে অনেকদিন ধরে চিনি। এই পার্ক স্ট্রিট, ট্রিঙ্কাজ, রাম ক্রেইন, ঊষা-এ ছিল স্বর্ণযুগ। হয়ত আমরা নস্টালজিয়া পুষে রেখেছি। সে সব অন্য রকম দিন ছিল। আমরা ফক্সট্রট, রাম্বা, সাম্বা, চা-চা-চা নাচতাম।"

 প্রথম বার

"জীবনের সব ভাল জিনিসই তো এখানে ঘটেছে। আমার স্বামীর সঙ্গে এখানেই আমার প্রথম দেখা হয়। শুধু সংগীত নয়, স্বাদের দুনিয়াতেও প্রথম এক সাক্ষাৎ ঘটেছিল তাঁর এই ট্রিঙ্কাজেই। দক্ষিণ ভারতীয় হিসেবে পনির কী জিনিস আমি জানতাম না। এখানেই আমি প্রথম পনির টেস্ট করেছিলাম", হাসতে হাসতে বলেন তিনি।

ট্রিঙ্কাজে এবার গান গাইতে ওঠার সময়ে ঊষা উত্থুপের পরণে ছিল সোনালি-কালো কাঞ্জিভরম শাড়ি, চুলে ফুলের মালা। ৫০ বছর পর, তিনি মঞ্চ থেকে দেখতে পেলেন বেশ কিছু চেনা মুখ - যে মুখগুলি সেই প্রথমদিনও তাঁর সামনেই ছিল।

Read the Full Story in English

Advertisment