"সত্য যুগে নারায়ণ, ত্রেতা যুগে রাম, দ্বাপর যুগে কৃষ্ণ, কলিতে চৈতন্য আর ঘোর কলি যুগে আমি।" এভাবেই নিজেকে সাক্ষাৎ ভগবান বলে দাবি করে থাকেন সিংহরায়। ভারতীয় সর্বশক্তিমান সনাতন ধর্মপ্রচার বিভাগের সৃষ্টিকর্তা। তাঁর স্বঘোষিত পরিচিতি, তিনি প্রথম পুরুষ ধর্মাত্মা সিংহরায় মহাপ্রভু।
ভূমিকা পড়ে মোটেই কোনও সিদ্ধান্তে আসবেন না। অনেকেই হয়ত ভাবছেন, এ আর নতুন কী? কিন্তু এ তো সবে শুরু। সিংহরায় হলেন সেই ব্যক্তি, যিনি নিজের মূর্তি ভগবানরূপে স্থাপন করে আসানসোল শিল্পাঞ্চল জুড়়ে হইচই ফেলে দিয়েছেন। দীর্ঘ ৪২ বছর ধরে তিনি নিজের মূর্তির সামনে সাধনা করছেন। নিত্য পুজো অর্চনা করেন। এ এক অন্য জগত। তাঁর পাশেই মন্দিরে রয়েছেন দুর্গা, শিবসহ অন্যান্য ঠাকুর দেবতা। তিনি নিজের একটি মূর্তি স্থাপন করেছেন মন্দিরে, আর একটি রয়েছে বাইরে ছাউনির নীচে।
মূর্তির আদলের সঙ্গে তাঁর যে মিল রয়েছে তা বোঝাতে তিনি মাথায় বাঁধা পাগড়ি খুলে ফেললেন। মেলে ধরলেন তাঁর জটা। একটা জটা প্রায় সাত ফুটের মত দীর্ঘ। তাঁর কথায়, "৪২ বছর আগে আমি যেমন দেখতে ছিলাম সেভাবেই নির্মান করা হয়েছিল মন্দিরের মানবরূপী দেবতার মূর্তি।" তার প্রমান দিতে মূর্তির পাশে দাঁড়িয়ে রীতিমত পোজ দিয়েও দেখালেন, তিনিই ওই অবয়ব। এখন যে বয়সটা অনেক হয়েছে! দেখার ফারাক হওয়াটাই স্বাভাবিক। তখন ছিল ৩০, এখন যে ৭২।
মহাপ্রভু তাঁর জীবন কাহিনীও শুনিয়েছেন। কীভাবে যে তিনি ঈশ্বরের দূত হয়ে উঠেছেন, সেই গল্পও শুনিয়েছেন ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলার প্রতিনিধিকে। তাঁর জন্ম ১৯৪৭ সালে সাঁওতাল পরগণার পাকুড় জেলায়। তবে মনে নেই জন্ম তারিখ। কাজের সন্ধানে ১৯৬৮ সালে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছিলেন। পেটের টানে ভবঘুরে সিংহরায় নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন, দিন আনা দিন খাওয়া অবস্থা। ঘুরতে ঘুরতে একসময় আস্তানা গাড়েন শিল্পাঞ্চলে। তখন অনেকটাই নির্জন ছিল এই এলাকা। পূজার্চনা করা তাঁর বাল্যকালের অভ্যাস ছিলই। তিনি বলেন, "আমাদের দেবতা মারাং গুরু। মানে শিব। শিবের আরাধনা করে এসেছি ছোট থেকেই।" ১৯৭৬ সালে তিনি নিজের মূর্তি গড়ান আসানসোলের নিয়ামতপুর ৬ নং জজকুলাহিতে। মূর্তি স্থাপনের দিন থেকে যুগ পরিবর্তনের সূচনা বলেই তিনি মনে করেন। ২০১৩ সালে আরও একটি মূর্তি তৈরি করান। যদিও এই মূর্তিকে নারায়নের প্রতমূর্তি হিসেবে দেখেন তিনি।
সিংহরায়ের দাবি, "ভগবান মানুষের মধ্যেই বিরাজ করেন। আমিই ভগবান। মানুষ রূপে আমিই নারায়ন। আমার আত্মা আমাকে নির্দেশ দিয়েছে ওই মূর্তি নির্মান করতে।" ১৩ মার্চ বার্ষিক উৎসব হয় এখানে। হাজার হাজার ভক্ত ভিড় করেন এই মানব মূর্তির মন্দিরে, ভক্তিভরে পূজো দেন। সিংহরায় নিজে নিত্য ফুল বেলপাতা দিয়ে জোর গলায় মন্ত্রোচ্চারন করে পূজো করেন। শ্রীশ্রী সিংহরায় বাবা ধামে এসেছেন ঝাড়খন্ডের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী শিবু সোরেন পর্যন্ত। রায় বাবার দাবি, "অনেক ভক্তের মধ্যে শিবু সোরেনও একজন। তবে কেউ অন্যায় করলে ছাড় পাবে, তা ভাবা উচিত নয়। যে যেমন কাজ করবে তেমনই ফল পাবে।"
সারাদিন আশ্রমেই থাকেন ঘোর কলির এই স্বঘোষিত মহাপুরুষ। শুধু দিনে দুবার বাড়িতে খেতে যান। কোনও দিন আবার খাবার চলে আসে আশ্রমে। এখন তাঁর ঘরবাড়ি বলতে এই আশ্রম। এই পাড়ার পাশেই তাঁর বাড়ি। ভরা সংসারে চার মেয়ে ও এক ছেলে। সবারই বিয়ে হয়ে গিয়েছে, জানালেন সিংহ মহারাজ।
অনেক ঝড়ঝাপটা সামলেছেন জীবনের শুরুতে। তিনি বলেন, "জন্মের সময় মাকে হারিয়েছি। ছোট বয়সে বাবাও পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। দাদার কাছে মানুষ হয়েছি। কিছুটা পড়াশুনাও করেছি।" তাঁর কথায়, "পাপে পূর্ণ, অনাচারের পৃথিবীতে, যুগে যুগে ভগবানের হয়ে দূত এসেছেন। আমিও ভগবানের সেই দূত।"